মালয়েশিয়া অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে করা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলার বাদী চাঁদাবাজিসহ যেসব অভিযোগ আসামিদের বিরুদ্ধে উপস্থাপন করেছেন সেগুলোর প্রমাণ না মেলায় মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। মামলায় চাঁদাবাজি ও মানব পাচারের অভিযোগ আনা হলেও তার সত্যতা পায়নি সিআইডি।
এছাড়া রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা এক লাখ ৫০ হাজার টাকা করে নেওয়ার কথা বলা হলেও শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আরও সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা করে নিয়েছে এজহার বা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টন থানায় করা মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করেন আফিয়া ওভারসিজের মালিক আলতাব খান। ওই মামলা করার ২০ দিনের মাথায় মানব পাচারের অভিযুক্ত হয়ে আলতাব নিজেই মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় গ্রেপ্তার হন। এছাড়া আলতাব খানের করা ভুল অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রেকর্ড ও পরবর্তীতে ইন্টারপোলের কাছে চিঠি লেখাসহ তদন্ত প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন এসআই, তদারকি কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট পল্টন থানার ওসি ও পুলিশ সদর দপ্তরের এসপিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তরকে চিঠি দিয়েছে সিআইডি।
তদন্ত সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে, পল্টন থানায় আলতাব খানের করা মামলায় এজাহার নামীয় আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোড-৩৮৫/৩৮৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু মামলার আসামিরা কোন মাধ্যমে, কোন প্রক্রিয়ায়, কত টাকা, কোন ঘটনাস্থলে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটিয়েছে তা উল্লেখ করে নেই। মামলার এজাহারে ঘটনাস্থল হিসেবে ‘আফিয়া ওভারসীজ ঠিকানা’ দেখানো হলেও সংশ্লিষ্ট ঘটনাস্থলে আসামিদের যাওয়া কিংবা সংঘটিত ঘটনার কোনো বিবরণ উল্লেখ করা হয়নি। অপরাধ সংগঠনের ঘটনাস্থলের কোনো সিসি ফুটেজ পাওয়া যায়নি। বা থেকে থাকলে বাদী কর্তৃক বিজ্ঞ আদালতে অথবা তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট উপস্থাপন করা হয়নি। ওই মামলার এজাহারনামীয় ১০৩নং আসামী শেখ আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো প্রকার অভিযোগ এজাহারে না থাকলেও কেন তাকে আসামি করা হয়েছে সে ব্যাখ্যা বাদী উপস্থাপন করতে পারেননি। বাদীর সঙ্গে এজাহারনামীয় ২৬ আসামির আর্থিক লেনদেনের কথা বাদী এফআইআরে বললেও টাকা লেনেদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। এজাহারে বাদীর তথ্য অনুযায়ী যে টাকা বাদী আসামিকে দিয়েছেন ওই টাকার উৎস সম্পর্কে বাদী কোনো বক্তব্য দেননি। ওই মামলায় ২৬ জন ব্যতীত অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য এজাহারে নেই। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো দালিলিক কাগজপত্রও বাদী উপস্থাপন করেননি এবং তদন্তকালে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়াও মানব পাচারের ১০ ধারা অনুযায়ী অপহরণ করার অপরাধের কথা উল্লেখ থাকলেও কোন ব্যক্তি কিভাবে অপহরণের স্বীকার হয়েছেন তা এজাহারে উল্লেখ নেই। পুলিশের তদন্তকালে কোনো কর্মীর অপহরণ সংক্রান্তে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আসামিদের জামিন দেওয়ার সময় আদালত মামলায় মানব পাচারের উপাদান নেই মর্মে উল্লেখ করে আদেশ দেন এবং আসামিদের জামিন মঞ্জুর করেন।
অত্র মামলার বাদী নিজে কোন যাত্রীর কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছেন তিনি যে সব লোককে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রসেস করেছেন তাদের মধ্যে কেউই বাংলাদেশ বা মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কোনো মামলা কিংবা অভিযোগ করেননি।
সিআইডি আরও জানিয়েছে, মানব পাচার আইনের ধারার মামলা হওয়ায় এবং এই ধরনের মামলা তদন্তের সময় সীমা নির্ধারিত থাকায় প্রায় নয় মাস তদন্ত করেও কোনো ধরনের দালিলিক কিংবা মৌখিক সাক্ষ্য না পাওয়ায় মামলাটি মুলতবি না রেখে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়।
এদিকে মামলাটিতে তথ্যগত উপাদান না থাকলেও তা রেকর্ড করেন পল্টন থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মো. নাসিরুল আমিন। ওই মামলায় শুধু গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ। অথচ প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম সব আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে জানিয়ে মালয়েশিয়া সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি ওই দেশের ইমিগ্রেশনের সফটওয়্যার ‘এফডব্লিউসিএমএস’ বন্ধ রাখার আবেদন করেন। এই চিঠি ওসির মাধ্যমে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি আলী হায়দার চৌধুরীর কাছে পাঠানো হয়। তিনি চিঠিটি সরাসরি মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী এসব চিঠি পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। এই প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করায় ওই তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ সদরদপ্তরে চিঠি দিয়েছে সিআইডি। এদিকে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর আলোচিত ‘কাউন্টার সেটিং’ সিন্ডিকেটের এজেন্ট সন্দেহে আলতাব খানকে গ্রেপ্তার করে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়।
মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলায় মানব পাচারের আরেকটি অভিযোগ করা হয়। মানব পাচারের অপহরণের পর ভয়ভীতি দেখিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা আদায়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী কোথাও কোনো মামলা বা অভিযোগ করেননি। এ ছাড়া মালয়েশিয়াতে লোক পাঠানোর নামে ২৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত নিয়ে আত্মসাৎ হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এই হিসাব ধরলে দেখা যায়- যারা গেছে তারা জনপ্রতি প্রায় ৫ লাখ টাকা দিয়ে গেছে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ১০১ এটি এজেন্সি মালিক ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকরা মালয়েশিয়া যেতে ব্যয় করেছেন ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত। এই অতিরিক্ত অর্থ কারা কিভাবে নিয়েছে অভিযোগ ও তদন্তে সেটা তুলে ধরা হয়নি।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পরিদর্শক মো. রাসেল কালবেলাকে বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণসহ মাঠপর্যায়ের তদন্তে যা পাওয়া গেছে সেটাই উল্লেখ করা হয়েছে। চাঁদাবাজি ও মানব পাচারের যে দুটি অভিযোগ আমাদের কাছে ছিল সেটার প্রমাণ না মিলায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন