

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং ইউনিসেফের যৌথ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)-২০২৫-এ দেশের শিশু ও নারীর সার্বিক পরিস্থিতির একটি জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চিত্র উঠে এসেছে। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিবাহ ও শিশুমৃত্যু কমেছে। একই সঙ্গে সি-সেকশন, শিশুশ্রম, স্কুলবহির্ভূত শিশু এবং রক্তে সিসার উচ্চমাত্রার মতো উদ্বেগজনক সূচক বেড়েছে।
রোববার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর জরিপ করা হয়। ১৭২টি মানদণ্ড এবং এসডিজির ২৭টি সূচক বিশ্লেষণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে সামগ্রিক মূল্যায়ন। প্রথমবারের মতো অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের রক্তস্বল্পতা এবং ভারী ধাতুর দূষণও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতি দুটি মেয়ের একটি এখনো বাল্যবিবাহের শিকার। ২০১৯ সালের ৬০ শতাংশ থেকে কমে বর্তমানে এ হার ৫৬ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৮ বছরের আগে বিবাহের হার ৫১ শতাংশ থেকে নেমে হয়েছে ৪৭ শতাংশ। কিশোরী মাতৃত্ব বেড়ে প্রতি হাজারে ৮৩ থেকে হয়েছে ৯২।
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে প্রসব ১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে। একই সময়ে অস্ত্রোপচারে প্রসব ১৬ শতাংশ বেড়ে এখন প্রায় ৫২ শতাংশ। বক্তারা এটিকে উদ্বেগের বিষয় বলে উল্লেখ করে সিজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারির পরামর্শ দেন।
নবজাতক থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু কমে হয়েছে প্রতি হাজারে ৩৩, যা আগে ছিল ৪০। খর্বকায় শিশুর হার ৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে। তবে শীর্ণকায় শিশুর হার বেড়ে ১৩ শতাংশ এবং কম ওজনের শিশুর হার সামান্য বেড়ে ২৩ শতাংশ হয়েছে। মাধ্যমিক স্কুলবয়সী শিশুদের স্কুলে না থাকার হার ২ শতাংশ বেড়ে ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিশুশ্রমও বেড়ে হয়েছে ৯ শতাংশ।
জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার ৫ শতাংশ কমে হয়েছে ৫৮ শতাংশ। মোট প্রজননহার ২ দশমিক ৩ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৪ হয়েছে। প্রসবপূর্ব সেবায় ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে, অন্তত একবার সেবা নেওয়ার হার ৫৮ থেকে বেড়ে ৭৬ শতাংশ। তবে চারবার মানসম্মত সেবা নেওয়ার হার এখনো মাত্র ৪৩ শতাংশ।
জরিপের অন্যতম উদ্বেগজনক ফল হলো সিসা দূষণ। ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশ এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় ৮ শতাংশের রক্তে সিসার মাত্রা নিরাপদ সীমার ওপরে। ঢাকায় এ হার সবচেয়ে বেশি, ৬৫ শতাংশ। পানি উৎসের অর্ধেক এবং গৃহস্থালির ৮০ শতাংশ পানির নমুনায় ই. কোলাই পাওয়া গেছে।
ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, বাল্যবিবাহ ও শিশুমৃত্যুর হার প্রমাণ করে অগ্রগতি সম্ভব। সিসাদূষণ ও শিশুশ্রমের মতো সংকট লাখ লাখ শিশুকে সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করছে। শিশুদের সুরক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী। এমআইসিএসের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা এমদাদুল হক প্রতিবেদনের মূল তথ্য উপস্থাপন করেন। মুক্ত আলোচনা পর্বটি সঞ্চালনা করেন বিবিএসের উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করার সময় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, উন্মুক্ত উপাত্তের দিকে এমআইসিএসের এই প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা। বড় পরিসরে আলোচনার জন্য এই উপাত্ত যেন সহজলভ্য হয়। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দুটো উপাত্ত এসেছে। নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে কোনটা ব্যবহার করা হবে, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। কোনো ক্ষেত্রে হার কেন বাড়ছে, কোনো ক্ষেত্রে কেন কমছে—সেই পেছনের গল্পগুলো উঠে আসা উচিত। জরিপের মান বাড়াতে হবে।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্যঁ পেস্ম, ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান, সাবেক সচিব মো. সারোয়ার বারী এবং আইসিডিডিআরবির পুষ্টি গবেষণা বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক থাডেয়াস ডেভিড মে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা পরিষ্কার ডেটা ব্যবহার, সঠিক ব্যাখ্যা এবং নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কোনো সূচক কেন বাড়ল বা কমল, সেই ব্যাখ্যাই বাস্তব নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্য করুন