

কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ বিলম্বিত করতে ব্যবহারিক প্রজনন স্বাস্থ্যজ্ঞান ও পরিবার পরিকল্পনা সেবার গুরুত্ব নতুন করে উঠে এসেছে গাইবান্ধা জেলার ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, যেসব কিশোরী নিয়মিত প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা, কাউন্সেলিং ও পরিবার পরিকল্পনা সহায়তা পেয়েছে, তাদের মধ্যে গর্ভধারণের হার নিয়ন্ত্রিত (কন্ট্রোল) গ্রুপের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর ‘দ্য ডেইলি স্টার সেন্টার’ -এ আয়োজিত ‘কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ বিলম্বিতকরণ : ব্যবহারিক প্রজনন স্বাস্থ্য জ্ঞানের কার্যকারিতা’ শীর্ষক গবেষণার মিডলাইন জরিপের ফলাফল উপস্থাপনের জন্য আয়োজিত কর্মশালায় এ ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
গবেষণা অনুযায়ী, হস্তক্ষেপপ্রাপ্ত দলের (ইন্টারভেনশন গ্রুপ) কিশোরীদের মধ্যে কখনো গর্ভবতী হওয়ার হার ৮.৫ শতাংশ, যেখানে নিয়ন্ত্রণ দলের (কন্ট্রোল গ্রপ) ক্ষেত্রে এ হার ১৮ শতাংশ। একইভাবে, বর্তমানে গর্ভবতী কিশোরীর হার ইন্টারভেনশন গ্রুপে ৬ শতাংশ, যা কন্ট্রোল গ্রুপে ১৬ শতাংশ।
গবেষকরা জানান, এ পার্থক্য পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং কিশোরী গর্ভধারণ বিলম্বিত করতে সরাসরি প্রজনন স্বাস্থ্য জ্ঞানের ভূমিকা নির্দেশ করে।
মিডলাইন জরিপে আরও দেখা যায়, প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা পাওয়া কিশোরীদের মধ্যে গর্ভধারণ দেরিতে করার আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি। ইন্টারভেনশন গ্রুপের ৮৮ শতাংশ কিশোরী জানিয়েছে তারা গর্ভধারণ বিলম্বিত করতে চায়, যেখানে কন্ট্রোল গ্রুপে এই হার ৬৭ শতাংশ। পাশাপাশি মেয়েদের বৈধ বিয়ের ন্যূনতম বয়স সম্পর্কে সঠিক ধারণা রয়েছে ইন্টারভেনশন গ্রুপের প্রায় ৯৭ শতাংশ কিশোরীর, যা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রকল্পটির প্রভাব লক্ষ করা গেছে। জরিপে থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে উঠে এসেছে মোট কিশোরীর ৮৬.৬ শতাংশ এখনো শিক্ষায় যুক্ত রয়েছে। গবেষকদের মতে, প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা কিশোরীদের আত্মবিশ্বাস ও সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা বাড়ায়, যা স্কুলে টিকে থাকার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
জাপানের ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট ইকোনমিক্স এবং ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র -এর সহায়তায় মমদা ফাউন্ডেশন গাইবান্ধা সদর ও সাঘাটা উপজেলার ১২০টি গ্রামের ১২০০ কিশোরী মেয়েদের উপর গবেষণাটি পরিচালনা করে। গবেষণাটিতে হস্তক্ষেপমূলক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় ৬০টি কিশোরী ক্লাব, যেখানে এক বছর ধরে নিয়মিত মাসিক সেশন, ব্যক্তিগত কাউন্সেলিং, জরুরি প্রয়োজনের জন্য হেল্প লাইন সেবা এবং বিবাহিত কিশোরীদের জন্য বিনামূল্যে পরিবার পরিকল্পনা কিট বিতরণ করা হয়।
প্রকল্পটি তিনটি ধাপে পরিচালিত হয়— ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত বেসলাইন জরিপ, ফেব্রুয়ারি-২০২৪ থেকে জানুয়ারি-২০২৫ পর্যন্ত ইন্টারভেনশন এবং ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত মিডলাইন জরিপ, যেখানে মোট ১,১৮৫ জন কিশোরীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রকল্পটির ইন্টারভেনশন কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করেছে রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ সার্ভিসেস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাডুকেশন প্রোগ্রাম (আরএইচস্টেপ)।
কর্মশালায় গবেষণার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন আইডিই -এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো প্রফেসর ড. মমএ ম্যাকিনো এবং মূল ফলাফল উপস্থাপন করেন ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. আবু এস. সঞ্চয়। ড. সঞ্চয় বলেন, সময়োপযোগী ও ব্যবহারিক প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য কিশোরীদের কাছে পৌঁছাতে পারলে তারা নিজের শরীর, শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়, যা কিশোরী গর্ভধারণ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্যে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আশরাফী আহমদ এনডিসি বলেন, এ গবেষণার ফলাফল জাতীয় পর্যায়ে কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য কর্মসূচি আরও শক্তিশালী করতে নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে এবং আমাদের জাতীয় কর্মসূচিগুলোকে আরও কার্যকরভাবে সাজাতে সহায়তা করবে। কিশোর-কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য কার্যক্রমে স্কুল, পরিবার এবং কমিউনিটির সমন্বিত ভূমিকা জোরদার করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, পাশাপাশি কিশোরীদের জন্য বয়সোপযোগী, নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য তথ্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগগুলোকে আরও বিস্তৃতভাবে বিবেচনা করা দরকার। আজকের গবেষণার অভিজ্ঞতা ও শিখন আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ইনপুট হিসেবে বিবেচিত হতে পারে— বিশেষ করে কিশোরী স্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ক্ষেত্রে।
তিনি আরও বলেন, কিশোরীদের সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য দেওয়া মানে শুধু একটি গর্ভধারণ বিলম্বিত করা নয়; বরং একটি প্রজন্মকে সুস্থ, শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত করে গড়ে তোলার পথে বিনিয়োগ করা।
গবেষকদের মতে, মিডলাইন জরিপের এই ফলাফল ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কিশোরী স্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বিস্তারে কার্যকর দিকনির্দেশনা দেবে। অনুষ্ঠানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা, বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন