

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের (আইডিপি) সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় গণনা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। দেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪ জেলা, ৪ হাজার ৫৭৯টি ইউনিয়ন, ৩২৯টি পৌরসভা ও ৪৮০টি সিটি করপোরেশন ওয়ার্ডজুড়ে পরিচালিত এই গণনা অনুযায়ী, বর্তমানে ৪৯ লাখ ৫৫ হাজার ৫২৭ জন মানুষ দেশের ভেতরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছেন।
মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই পরিসংখ্যানগত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
আইওএম জানায়, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙনসহ নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষের জীবন কীভাবে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা এই গণনা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে দুর্যোগজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির কোনো নিশ্চিত জাতীয় পরিসংখ্যান ছিল না।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে তথ্য সংগ্রহের সময় ২৯ হাজারের বেশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতা সাক্ষাৎকার ও ৫ হাজার ৩৮৮টি মাঠ পরিদর্শন করা হয়। এটি বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বাস্তুচ্যুতি বিষয়ে পরিচালিত সর্ববৃহৎ গবেষণা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইওএম বাংলাদেশ মিশন প্রধান ল্যান্স বোনো বলেন, ‘বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা জানা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ফলাফল জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আরও সুসংগঠিত পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে।’
প্রতিবেদনে উঠে আসে, দুই-তৃতীয়াংশ (৬৩ শতাংশ) মানুষ ২০২০ সালের এপ্রিলের আগেই বাস্তুচ্যুত হয়— যা দীর্ঘমেয়াদি ও অমীমাংসিত বাস্তুচ্যুতির প্রতিফলন। এক-চতুর্থাংশ (২৫ শতাংশ) মানুষ ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিলের মধ্যে বাস্তুচ্যুত হন। বিভাগভিত্তিক চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বাধিক ১২.১ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ রয়েছেন; এরপর ঢাকা বিভাগে ৭.৯ লাখ ও রাজশাহীতে ৬.৬ লাখ। মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের এক-চতুর্থাংশ রয়েছে চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, ভোলা ও নোয়াখালী— এই চার জেলায় এবং ৮৫ শতাংশ বাস্তুচ্যুত মানুষ গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করছেন।
সরকার এই গণনাকে ‘অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনার জাতীয় কৌশল’ বাস্তবায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সরকারি কৌশলে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর নিয়মিত ও কাঠামোগত তথ্য সংগ্রহের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আবদুল ওয়াদুদ, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ সাইফুল্লাহ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি ইভা আতানাসোভা বক্তব্য দেন।
গণনা পদ্ধতি উপস্থাপন, প্রতিবেদন উন্মোচন এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির তথ্য সরকারি ডেটা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। অংশ নেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিসিএস ব্যুরো এবং উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিনিধিরা।
আইওএমসহ সহযোগী সংস্থাগুলো বাংলাদেশে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থিতিশীল দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ধারাবাহিক সহায়তার আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির এই প্রথম জাতীয় গণনাকে বিশেষজ্ঞরা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। নীতিনির্ধারকদের মতে, এটি ভবিষ্যতের দুর্যোগ প্রস্তুতি, পুনর্বাসন, সামাজিক সুরক্ষা, জলবায়ু অভিযোজন ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মন্তব্য করুন