বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল। আগে এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন সম্পর্কিত একটি রুলের রায়ে এই সংগঠনের নিবন্ধন অবৈধ এবং একে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করে।
জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পাকিস্তান বিভক্তির বিরোধিতা করেছিল। দলটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যায় সহযোগিতা করেছিল। দলটির সদস্যরা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নতুন সরকার জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরে পাকিস্তানে চলে যান দলের নেতারা। ১৯৭৫ সালে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর এবং কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৭৭ সালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
১৯৮০-এর দশকে জামায়াত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বহুদলীয় জোটে যোগ দেয়। এ সময় দলটি আওয়ামী লীগ ও সমসাময়িক বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে, পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করে। জামায়াতে ইসলামী ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে মিলিত হয় এবং আরও দুটি দলসহ চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট জয়লাভ করলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে জামায়াতের দুজন সদস্য মন্ত্রী হন। ২০০৮ সাল থেকে দলটির জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি ৩০০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫টি আসন লাভ করে।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। ২০১২ সালের মধ্যে দুজন বিএনপি নেতা ও জামায়াতের সাবেক এবং বর্তমান সদস্যসহ ৮ জন নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করা হয়। ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত জামায়াতের সাবেক সদস্যসহ মোট চারজনকে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড, একজনকে যাবজ্জীবন ও সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী। জামায়াত ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতা ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর মওদুদী ভারত থেকে পাকিস্তান চলে যান।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর জামায়াতে ইসলামী মূলত ভারত ও পাকিস্তান দুটি অংশে ভাগ হয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের শাখা থেকে সৃষ্টি হয়।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণিত মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করায় ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মওদুদীসহ ৬০ জন জামায়াত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন। গোলাম আযম তাদের একজন। ওই বছর অক্টোবরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন ঘোষণার সময় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেয় এবং ১৯৬৫ সালে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জোট গঠন করা হয়। পরে আওয়ামী লীগের ছয় দফা এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত ১১ দফার তীব্র বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পশ্চিম পাকিস্তানে চারটি আসন লাভ করে। যদিও মুক্তিযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানি শাসকদের নির্দেশে গঠিত প্রাদেশিক সরকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা।
১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আল শামসসহ বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে এবং এসব অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন নেতাকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন