আজ শুক্রবার (১ আগস্ট) বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস। মায়ের দুধের প্রয়োজনীয়তা ও শিশুর স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। একইসঙ্গে প্রতি বছর ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহও পালন করা হয়ে থাকে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোয় উৎসাহ দিতে এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে এই কর্মসূচি।
ম্যাক্স হেলথ কেয়ার জানিয়েছে, এবারের ২০২৫ সালের বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘স্তন্যপানকে অগ্রাধিকার দিন : টেকসই সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তুলুন’। এই প্রতিপাদ্যটি স্তন্যপানের গুরুত্ব এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। তার প্রতিপাদ্য বিষয় সাধারণত ‘কাজের মাঝে শিশু করবে মায়ের দুধ পান, সবাই মিলে সবখানে করি সমাধান’। এটি মূলত মাতৃদুগ্ধ পানের গুরুত্ব এবং সামাজিক সমর্থন ও সুরক্ষার উপর জোর দেয়।
১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হয়ে আসছে। ২০১০ সাল থেকে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ জাতীয়ভাবে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে। বিশ্ব দুগ্ধ দিবস এবং বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয় দুটি ভিন্ন এবং উভয়ই নিজ নিজ স্থানে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। ২৫ সালের বিশ্ব দুগ্ধ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো : ‘আসুন দুগ্ধের শক্তি উদযাপন করি’। এই প্রতিপাদ্যটি দুগ্ধজাত পণ্যের পুষ্টিগুণ, জীবিকা নির্বাহে এর ভূমিকা এবং টেকসই খাদ্য ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব তুলে ধরে। অর্থাৎ, বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২৫-এ দুগ্ধের গুরুত্ব, পুষ্টিগুণ এবং সমাজের উপর এর প্রভাবকে উদযাপন করার জন্য এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ অথবা বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ একটি বার্ষিক উদ্যাপন যা প্রতি বছর পৃথিবীর ১২০টিরও বেশি দেশে পালন করা হয়। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোয় উৎসাহ দিতে এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে এই কর্মসূচি। বিশ্বব্যাপী বুকের দুধ খাওয়ানোর চর্চা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সর্বত্র স্তন্যদানের জন্য সহায়তা প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ডব্লিউএবিএ গঠিত হয়েছিল। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সচেতনতামূলক প্রচার, অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মাতৃদুগ্ধ পান এবং বিকল্প শিশুখাদ্য বিষয়ক অবহিতকরণ কর্মসূচি। সরকার বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং কমিউনিটি পর্যায়ে এ বিষয়ক নির্দেশনা দিয়েছে।
চওই জানিয়েছে, খাদ্য হিসেবে নয়, বরং একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানায়, যা শরীরকে পুষ্টি জোগায়, সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখে এবং অর্থনীতিকে আরও উন্নত করে। প্রথম আলো জানিয়েছে, এটি দুধের পুষ্টিগুণ, দুগ্ধ শিল্পের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং টেকসই দুগ্ধ খামারের উপর আলোকপাত করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মার্কিন শিশুরোগবিদ্যা একাডেমি (এএপি) বুকের দুধ খাওয়ানোর উপর খুব গুরুত্ব আরোপ করে, কারণ এটি মা আর শিশু উভয়ের জন্য অত্যন্ত লাভজনক। উভয়ই ছ’মাস বয়স পর্য্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে এবং এর পর দু’বছর বা তারও বেশি বয়স পর্যন্ত পরিপূরক খাদ্যের সঙ্গে নিয়মিত ভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়। শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় প্রায় তিন দশক আগে, যার ভিত্তি ‘ইনোসেন্টি ডিক্লারেশন’ নামের একটি স্মারকলিপি। এটি তৈরি করে জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৯৯০ সালে সে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে বিভিন্ন দেশের সরকার, ইউনিসেফ, ডব্লিউএইচওসহ অন্যান্য সংস্থা। বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ এই ইনোসেন্টি ঘোষণার স্মরণার্থে উদযাপিত হয়।
বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস এবং সপ্তাহ পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো- শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য মায়ের দুধের গুরুত্ব তুলে ধরা। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোতে মায়েদের উৎসাহিত করা। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মায়ের দুধের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক সমর্থন ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। মাতৃদুগ্ধ শিশুর জন্য একটি প্রাকৃতিক ও আদর্শ খাবার, যা তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অপরিহার্য। তাই, এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি।
বিশ্বের অনেক দেশে চালু রয়েছে ‘স্কুল মিল্ক প্রোগ্রাম’, যেখানে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের এক গ্লাস দুধ সরবরাহ করা হয়। এটি শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশেও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও সুস্থ ও মেধাবী হয়ে উঠবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দুধ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। উন্নত পশু চিকিৎসা, মানসম্মত খাদ্য ও টেকসই খামার ব্যবস্থাপনা দুধ উৎপাদনকে পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারে। সরকার ও বেসরকারি খাতে ইতিমধ্যেই নানা উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে, যেখানে প্রাণীর কল্যাণ ও পরিবেশ সুরক্ষাও গুরুত্ব পাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মার্কিন শিশুরোগবিদ্যা একাডেমি (এএপি) বুকের দুধ খাওয়ানোর উপর খুব গুরুত্ব আরোপ করে, কারণ এটি মা আর শিশু উভয়ের জন্য অত্যন্ত লাভজনক। উভয়ই ছ’মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে এবং এর পর দু’বছর বা তারও বেশি বয়স পর্যন্ত পরিপূরক খাদ্যের সঙ্গে নিয়মিত ভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়।
চিকিৎসকদের মতে, শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর কোনো বিকল্প নেই। জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ দিলে মায়ের গর্ভফুল তাড়াতাড়ি পড়ে, সহজে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়, ফলে মা রক্তস্বল্পতা থেকে রক্ষা পান। এ ছাড়া দ্রুত দুগ্ধপানে মায়ের জন্ম বিরতিতে সাহায্য করে, স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমায়।
মাতৃদুগ্ধ পান শিশুর সর্বোচ্চ শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করে। এ ছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, ডায়রিয়ার ঝুঁকি কমায়, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ এবং কানের প্রদাহ কমায়। একইসঙ্গে দাঁত ও মাড়ি গঠনে সহায়তা করা ছাড়াও মায়ের দুধ শিশুর অনেক উপকার করে থাকে। মায়ের দুধ না খাওয়ালে শিশুদের নানারকম রোগ হতে পারে। যেমন শিশুর নিউমোনিয়াজনিত মত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৫ গুণ ও ডায়রিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১১ গুণ বেড়ে যায়। শিশুদের অপুষ্টি ও অন্যান্য কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৪ গুণ বেড়ে যায়। শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়।
মাতৃদুগ্ধ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত কর্মসূচিগুলোর মধ্যে রয়েছে: ১। সচেতনতামূলক প্রচারণা : বিশ্বব্যাপী মাতৃদুগ্ধ পানের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং নবজাতকদের বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য উৎসাহিত করা হয়।
২। বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি : অন্তঃসত্ত্বা মা, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মাতৃদুগ্ধ দান, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য এবং পুষ্টি বিষয়ক অবহিতকরণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
৩। কর্মসংস্থান সৃষ্টি : কর্মজীবী মায়েদের জন্য কর্মক্ষেত্রে শিশুর যত্নের স্থান এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য বিরতি নিশ্চিত করার জন্য প্রচার চালানো হচ্ছে।
৪। জাতীয়ভাবে উদযাপন : ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে।
৫। বিভিন্ন সংস্থার অংশগ্রহণ : স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জাতীয় পুষ্টিসেবা, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন (বিবিএফ) এবং অন্যান্য সহযোগী সংস্থা এই সপ্তাহ পালনে একসাথে কাজ করছে।
৬। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে : শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোয় উৎসাহ দিতে এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে এই কর্মসূচি।
এবারের বা ২০২৫ সালের বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবসের প্রতিপাদ্য - ‘স্তন্যপানকে অগ্রাধিকার দিন: টেকসই সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তুলুন’। এই প্রতিপাদ্যটি কেবল মুখে বলা এবং কাগজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সকলের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এ সময়ের সময়ের দাবি বলে মনে করি।
লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন, কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল।ইমেইল এড্রেস : [email protected]
মন্তব্য করুন