প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়ার স্থিতিশীলতার জামিনদার ও রাষ্ট্রত্ব রক্ষার আপসহীন রক্ষক হিসেবে পরিচিত। তবে গত সপ্তাহান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনায় রাশিয়ার সেই স্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুতিনের ২৩ বছরের শাসনামলে যখন সবচেয়ে নাটকীয় চ্যালেঞ্জটি আসল তখন তিনি বক্তব্য দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলেন।
তার অনুপস্থিতিতে রাশিয়ানদের হতবাক করে দিয়ে একটি প্যারামিলিটারি গ্রুপের নেতা ইয়েভগেনি ভি প্রিগোজিন সশস্ত্র বিদ্রোহ করলেন এবং মস্কোতে পৌঁছানোর হুমকি দিলেন। এতে করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি আসল তা হলো, বিদ্রোহ রোধ করে নিরাপত্তাবিধানে তিনি কি ব্যর্থ? এবং তার ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি কি আগের মতোই শক্ত অবস্থানে রয়েছে?
প্রিগোজিনের এই উত্থানে রাশিয়ায় কোনো গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটেনি বলে ক্রেমলিনের সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ রাশিয়ানরা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছেন। তবে তারা এ বিষয়েও একমত যে, পুতিন এখানে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন এবং তা এই দুর্বলতা দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে।
ক্রেমলিনের সঙ্গে জড়িত মস্কোর একটি পত্রিকার সম্পাদক কন্সটানটিন রেমচুকভ টেলিফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যা একসময় চিন্তার অতীত ছিল তা আজ সম্ভব হয়েছে। পুতিনের কাছের মানুষ বলে বিবেচ্যরা আসন্ন বসন্তে প্রেসিডেন্ট পুনর্নিবাচনে পুতিন যেন না দাঁড়ান সে বিষয়ে রাজি করাচ্ছেন। শনিবারের ঘটনার পর এই সম্পাদক মনে করেন, পুতিন রাশিয়ার জনগণের ধনসম্পদ ও নিরাপত্তার রক্ষাকর্তা হিসেবে তার অবস্থান চূড়ান্তভাবে হারিয়েছেন।
রেমচুকভ বলেন, ‘পুতিন ক্ষমতায় আসীন আছেন এবং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করে চলেছেন- এই ধারণা ব্যর্থ হয়েছে চলতি মাসের ২৪ তারিখে। এক মাস আগেও আমি ভাবতাম পুতিন তার ইচ্ছা অনুযায়ী চলবেন কারণ এটা তার অধিকার। কিন্তু এখন দেখছি নাগরিকরা আর দ্ব্যর্থহীনভাবে নিরাপদ বোধ করতে পারছেন না।’
রাষ্ট্রের ‘স্থিতিশীলতা’ রক্ষার শর্তে গণভোটের মাধ্যমে ২০২০ সালে পুতিন দুই মেয়াদের জন্য ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় এসেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাশিয়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ইউক্রেনে আক্রমণ জরুরি ছিল বলে পুতিন মনে করেন।
ইউক্রেনে ১৬ মাসব্যাপী যুদ্ধ যখন চলছে তখনো ক্রেমলিন নিজ দেশে স্বাভাবিকতা রক্ষার প্রতি দায়বদ্ধ। পুতিন কোনোপ্রকার কড়া নির্দেশ ব্যতিরেকে মার্শাল ল কায়েম করা থেকে বিরত থেকেছেন। তিনি দেশের কোনো সীমান্তও বন্ধ ঘোষণা করেননি। রাশিয়ার যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন রাশিয়ার ব্যবসায়ীরা। ফলে পশ্চিমা প্রতিযোগিতা ছাড়া রাশিয়ায় স্বদেশী পণ্যের বাজার চাঙ্গা হয়েছে।
তবে ক্রেমলিনের কর্তৃত্বে প্রিগোজিনের চ্যালেঞ্জ এসব সমীকরণে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। প্রিগোজিন এবং তাদের সৈন্যরা ক্রেমলিন থেকে দক্ষিণে রুশ সামরিক কার্যালয় কব্জা করে ফেলে এবং উত্তরে মস্কোর দিকে সৈন্যদের দল রাজধানীতে ঢোকার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। পরে যখন শর্তসাপেক্ষে বিচার এড়াতে প্রিগোজিন তার সৈন্যদের সরিয়ে নিতে সম্মত হন তখন এই সংকট থেকে মুক্তি ঘটে।
প্রাথমিকভাবে এই হুমকি এড়ানো হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় পুতিন স্থিতিশীলতার যে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। পুতিনকে যেমনটা ভাবা হয় যে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করেন না, তার বিপরীতে কোনোপ্রকার শাস্তি ছাড়া প্রিগোজিন এবং তার বহরকে ছেড়ে দেওয়া বিবিধ প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
ব্যাপারগুলো আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন রাশিয়ান সামরিক ব্লগাররা জানান, ‘প্রিগোজিনবাহিনী রাশিয়ান সামরিক বিমান ধ্বংস করেছে।’ উল্লেখ্য, পুতিন এই বিদ্রোহ ঘোষণার পর এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন তোলার পর প্রিগোজিনকে বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যা দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এই পুরো ঘটনায় পুতিনের ভূমিকা তাকে পূর্বেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে কম কর্তৃত্ববাদী প্রমাণ করে। সেই সাথে বিদেশি প্রতিপক্ষরাও রাশিয়ার দুর্বলতা হিসেবে এই বিষয়টিকে লুফে নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে. ব্লিঙ্কেন রোববার বলেছেন, ‘প্রিগোজিনের বিদ্রোহের ফলে পুতিনের ক্ষমতার দেয়ালের ফাটল বেরিয়ে এসেছে। এটি পুতিনের কর্তৃত্বে সরাসরি চ্যালেঞ্জ।’ সিবিএসের ‘ফেস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে তিনি এসব বলেন।
আরেকটি বিষয় নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সেটি হলো- কেন পুতিন প্রিগোজিনের সঙ্গে আগে থেকে বিদ্যমান মতবিরোধ নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করেননি এবং কীভাবে এমন বিদ্রোহের সৃষ্টি হলো? প্রিগোজিন তীক্ষ্ণ ভাষায় স্পষ্টভাষী হয়ে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে খাটো করে প্রশ্ন তুলেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্রেমলিনের সাথে ঘনিষ্ঠ দুইজন নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, রাশিয়ার এই ক্রান্তিলগ্নকে তারা অকার্যকর সরকার ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা শুরুর প্রথম ফসল হিসেবে দেখছেন। রাশিয়ান ভাষার বারডাক শব্দটি এই অবস্থাকে কিছুটা প্রতিফলিত করে।
প্রিগোজিনের বিদ্রোহকে কীভাবে দমন করা যায়, শনিবার সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর আগে মাসের পর মাস ধরে পুতিন ও তার কাছের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা বিষয়টির কোনো সমাধান না খুঁজে বিষয়টিকে একটি খালি বোতলের মতো লাথি মারতে মারতে খাদের কিনারে নিয়ে গিয়েছেন।
রাশিয়ার সংসদে পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির একজন সিনিয়র সদস্য কনস্টানটিন যাতুলিন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটা এতদিন একটি অবহেলিত বিষয় ছিল। তিনি বলেন, সময় থাকতে এই সমস্যা চিহ্নিত করা যায়নি। হয়তো ভাবা হয়েছিল নিজে নিজেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
যাতুলিন দাবি করেন, পুতিন সেই সমাধান করেছেন এবং স্থিতি ফিরিয়েছেন। কেননা তিনি শেষে একটি চুক্তিতে আসতে সক্ষম হয়েছেন এবং মস্কোর বাইরে ভয়াবহ যুদ্ধ থামিয়েছেন। তবে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, এই নাটকে কারও ‘কর্তৃত্বেই নতুন কিছু যোগ হয়নি।’
যাতুলিন বলেন, ‘এখানে যে সমস্যা রয়েছে এটাই তার প্রমাণ। যুদ্ধাবস্থায় এমন সমস্যা নিয়ে জনসম্মুখে কথা বলা অবশ্যই ক্ষতিকর।’
ক্রেমলিনের সাবেক উপদেষ্টা ও এবং একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সের্গেই মারকভ বলেন, ‘পুতিনের জন্য এই বিদ্রোহ ‘অস্তিত্ব সংকটের’ সূত্রপাত ঘটাতে পারে। তিনি রাশিয়া রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে যে গর্ব করেন তার জন্যই রাশিয়ার জনগণ তাকে ভালোবাসত। তবে এখন দেখা যাচ্ছে আর সে অবস্থা বিরাজ করছে না।’
রুশ পত্রিকার সম্পাদক রেমচুকভ বলেন, প্রিগোজিনের কারণে রাশিয়ার রাজধানীতে যে ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়েছে তা বড় এবং ছোট পরিসরে অনুভব করা গেছে। তিনি বলেন, এমন অনেক রাশিয়ান ছিল যারা বিদ্রোহের দিনটিতে মস্কোতে চলে এসেছিল। রেমচুকভ ঘটনার দিনে মস্কোতে চুপচাপ বসে ছিলেন। প্রিগোজিনের বহর সত্যিকার অর্থে মস্কো পৌঁছে গেলে আটক করা হতে পারে ভেবে তিনি বেন্টলি বা মার্সিডিজ গাড়ি নিয়ে বের হননি।
বলাবাহুল্য, পুতিনের রাষ্ট্র পরিচালনা এখন পর্যন্ত যথেষ্ট স্থিতির নির্দেশনা দিয়ে গেছে। নিষেধাজ্ঞায় দেশের অর্থনীতি নেতিয়ে পড়েনি অথবা রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের কেউই ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অজস্র মানুষের প্রাণহানি হলেও বাস্তবুদ্ধিসম্পন্ন প্রপাগাণ্ডা এবং তীব্র দমননীতি জনগণের মতবিরোধকে বড় পরিসরে চুপ করিয়ে দিয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন এখুনি চলমান শাসন ব্যবস্থার ইতি ঘটবে, এমন পূর্বানুমান ভুল হবে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট হান্না নোট বলেন, ‘পশ্চিমা পর্যবেক্ষক হিসেবে আমরা গত কয়েকদিনে যা দেখলাম তা অকার্যকারিতার প্রতীক এবং নাটকীয়ও বটে। এমন একটি সিস্টেমে এ ধরনের অকার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদি ও মজবুত হয়ে উঠতে পারে।’
মূল লেখা : আন্তন ত্রোয়িনানোভস্কি, নিউইয়র্ক টাইমস ভাষান্তর : সরকার জারিফ
মন্তব্য করুন