দেশে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে প্রায় বছরজুড়েই। প্রধানত স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা সম্প্রতি স্কুলের শিক্ষা কারিকুলাম ও মান যাচাই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েছেন এবং তাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় ও কার্যকর জ্ঞানার্জনের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। এর অন্যতম কারণ নতুন কারিকুলামে পরবর্তীতে পাঠ্যবইসমূহ, স্কুলে পাঠদান পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রতি অভিভাবকদের আস্থাহীনতা।
চলমান বিতর্কে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে নিয়োজিত সরকারি কর্তৃপক্ষ আর অভিভাবকদের চিন্তাধারার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, শিক্ষা পদ্ধতির নতুন পরিবর্তনসমূহ নিয়ে আসা হয়েছে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে,আর মডেল হিসেবে অনুসরণ করা হয়েছে সারা বিশ্বের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় সর্বোৎকৃষ্ট বলে স্বীকৃত ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থাকে। কিন্তু এই সরকারি ব্যাখ্যা স্কুলের শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। ফলে অভিভাবকেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার হয়েছেন শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। আর সরকার তাদের যথাযথভাবে বোঝানোর মাধ্যমে সংস্কারের পক্ষে নিয়ে আসার বদলে জোর জবরদস্তির পথেই হাঁটছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এসব ডামাডোলের মধ্য দিয়ে মূল সমস্যা, এর প্রকৃতি আর সম্ভাব্য সমাধানের তথ্যভিত্তিক ও যুক্তিগ্রাহ্য আলাপটাই হারিয়ে যেতে বসেছে।
বর্তমানে আমরা যে ফিনল্যান্ড মডেলের অনুসরণ করার কথা বলছি, সেটা এবং এর আগে আমাদের মূলধারা শিক্ষা ব্যবস্থা উভয়েই ইউরোপীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরণে গড়ে উঠেছে। এই শিক্ষাব্যবস্থার জন্ম হয়েছে চার্চের প্রভাবাধীন মধ্যযুগীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের অধীন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে একটা দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহাসিক ও আদর্শিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। স্কুলগুলো পূর্বের রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের প্রভাববলয় থেকে ব্যক্তিকে বের করে নিয়ে এসে জাতিরাষ্ট্রের অনুগত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছে। স্কুলগুলো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির বাইরে এসে ভাষার প্রমিতকরণ আর জাতীয় পরিচয় নির্মাণের মাধ্যমে সমাজে আত্তীকরণ প্রক্রিয়াকে বেগবান করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যমান রাজনৈতিক ক্ষমতার পক্ষে বৈধতা উৎপাদন করে চলেছে। ইউরোপের রেনেসাঁ, প্রোটেস্টান্ট সংস্কারবাদী আন্দোলন, এনলাইটেনমেন্ট আধুনিক স্কুলের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেইসাথে শিল্পবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেছে যে, স্কুল সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। জাতীয় পরিচয় নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্কুলের ভূমিকা এখনো ব্যাপক।
ইউরোপে উদ্ভব হওয়া এই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ও শাসকেরা আধুনিক স্কুলকে ব্যবহার করেছে তাদের উপনিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে, তাদের শাসনের বিরোধিতা থেকে স্থানীয় জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ছড়িয়ে দিতে। পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল হয়ে দাঁড়িয়েছে আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও জাতিরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সংযোগের একটা কার্যকর মাধ্যম হিসেবে। এজন্য ইতিহাসের নানা প্রেক্ষাপটে কোন কোন উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে স্কুল ব্যবহার করা হয়েছে, সেদিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।
অভিভাবকরা যে শিক্ষা ব্যবস্থা চায় না তাদের সন্তান্তদের জন্য, রাষ্ট্র কেন সেটাকেই চাপিয়ে দিতে চায়? অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এবং তাদের যথাযথভাবে সুশিক্ষিত করার মাধ্যমে একটা সম্মানজনক, সুখী ও স্বাচ্ছন্দ্য জীবন গড়ার পথে চালিত করেন। অর্থাৎ, অভিভাবকরা সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করবে, সেই ভবিষ্যৎ যেন তাদের বর্তমানের থেকেও ভালো হয় যেই চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রের নাক গলানোর কি দরকার? আর কোন অধিকারের বলে রাষ্ট্রে শিক্ষানীতি নির্ধারণে ও শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনায় অংশ নেয়, এমনকি অভিভাবকদের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও?
সামাজিকবিজ্ঞানে, বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্কুল নিয়ে পঠনপাঠনের বেশ প্রভাবশালী একটা পরম্পরা আছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে আমেরিকান স্কলার জন ডিউই (John Dewey) লক্ষ্য করেন যে, জার্মান চিন্তাধারার প্রভাবে শিক্ষা হয়ে পড়েছে একটা নাগরিক কার্যক্রম যা জাতিরাষ্ট্রের আদর্শ বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত। উল্লেখ্য, জার্মান শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যে ব্যক্তিসত্তার উৎকর্ষ সাধন নয়, ছিল ব্যক্তিকে নিয়মকানুন মান্য করার প্রশিক্ষণ প্রদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সে জাতীয় স্কুল ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়বোধ জন্ম দিয়েছে। আধুনিকায়ন তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা মার্টিন লিপসেটের (S. M. Lipset) মতে, শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজবিজ্ঞানীদের দাবি, স্কুল মানবসম্পদ তৈরি করে এবং একইসাথে ব্যক্তিকে সমাজের একজন যোগ্য সদস্য হিসেবে শিক্ষিত করে গড়ে তোলে। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে শুরু করে পুরো ১৯ শতকজুড়ে ফ্রান্সের শাসকশ্রেণি একটা সমন্বিত জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ফরাসি নাগরিক তৈরির ওপর জোর দিয়েছে। ইতালির নানা অংশকে একীভূত করে বর্তমান জাতিরাষ্ট্র গঠনের পর শাসক শ্রেণি সেখানেও ইতালীয় নাগরিক নির্মাণের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ফ্রান্স ও ইতালি উভয় রাষ্ট্রেই শাসকরা জনগণের মধ্যে সমজাতীয়তা (commonality) এবং যথাযথ ‘ফরাসি’ ও ‘ইতালীয়’ নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে অনেকটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতি অনুসরন করে। এক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা। এর পাশাপাশি জাতিগঠন কর্মসূচির মধ্যে ছিল সমস্ত স্কুলের জন্য একটা জাতীয় ভাষা নির্ধারণ ও প্রচলন করা, নানা ধর্মীয় ধ্যানধারণা ও আচারবিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত করা, স্কুল পরিচালনা করা ইত্যাদি।
প্রখ্যাত সামাজিক বিজ্ঞানী চার্লস টিলি (Charles Tilly) লক্ষ্য করেন যে, প্রত্যেকটা ইউরোপীয় রাষ্ট্রই তাদের নিজ জিন জনগোষ্ঠীকে একীভূত করতে এবং তাদের মধ্যকার নানা সাংস্কৃতিক পার্থক্য কমিয়ে আনতে নানা রকম কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিল, যেমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে বহিষ্কার করা, প্রধান সম্প্রদায়ের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা, একটা নির্দিষ্ট ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলন করা এবং জনসাধারণের জন্য একটা সুনির্দিষ্ট গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু করা। একইভাবে আরেক স্কলার হবসবম (Hobsbawm) উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্র ক্রমবর্ধমান হারে স্কুলকে ব্যবহার করত জনগণের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে, তাদের মধ্যে জাতির ইমেজ ও ঐতিহ্য ছড়িয়ে দিতে এবং জাতির প্রতি তাদের একাত্মবোধের জন্ম দিতে। সেই সাথে তিনি এও বলেছেন, জনশিক্ষা এবং প্রশাসনিক নানা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে এলিট শ্রেণির ভাষা ও সংস্কৃতিই জাতিরাষ্ট্রের ভাষা ও সংস্কৃতি হিসেবে প্রচলিত হয়। মূলকথা হলো, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শাসকশ্রেণি জাতি গঠনের প্রচেষ্টা নেয় যেখানে জনগণের মধ্যে জাতি হিসেবে একাত্মবোধ থাকবে, তাদের সম্মিলিত স্বার্থ, লক্ষ্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সমন্বয় থাকবে।
দেশে স্কুল কারিকুলাম নিয়ে চলমান বিতর্কে স্কুল সংক্রান্ত দার্শনিক ও তত্ত্বীয় চিন্তাভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে বাস্তবতার দিকে নজর দেওয়াটাই বেশি জরুরি। বিশেষ করে স্কুলে শিক্ষাদানে সরাসরিভাবে নিয়োজিত শিক্ষকবৃন্দ ও অভিভাবকদের দৃষ্টিতে স্কুলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো কি কি হওয়া উচিত এই দিকে আলোকপাত করলে গ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে আমেরিকার Brooking Institute এর দুইজন ফেলো Emily Emily Markovich Morris এবং Ghulam Omar Qargha এর লেখা “In the quest to transform education, putting purpose at the center is key” প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। এখানে তারা উল্লেখ করেছেন, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের ফলে শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং পরিবারের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ২০২২ সালে সর্বপ্রথম জাতিসংঘের সাধারণ সম্পাদক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে একটা সম্মেলনের আয়োজন করেন। একই সাথে UNESCO, UNESCO Institute for Statistics, UNICEF, the World Bank, এবং the Organization of Economic Cooperation and Development (OECD) কোভিড পরবর্তীকালে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের একটা রোড-ম্যাপ হিসেবে সম্মিলিতভাবে রচনা করে “From Learning Recovery to Education Transformation” শীর্ষক একটা প্রতিবেদন। নানা পর্যায়ের ডোনার এজেন্সিগুলোও এসব পদক্ষেপে সংযুক্ত হয়। কিন্তু এসব আয়োজনের মধ্যে সমাজ ও প্রতিস্থানসমূহের দৃষ্টিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য কী তা অনুপস্থিত থেকে যায়।
শিক্ষার উদ্দেশ্য কী?:
আধুনিক রাষ্ট্রের দিক থেকে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জাতি গঠন। কিন্তু অভিভাবকের কাছে সন্তানের একটা সুন্দর, সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। আবার প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যালয়ের স্বার্থ হলো নির্ধারিত নীতি ও কার্যপ্রণালি অনুযায়ী স্কুল পরিচালনা করা যেন শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যথাযথভাবে অর্জন করা যায়। রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবক- এই তিন পক্ষের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রথম দেখায় আলাদা আলাদা মনে হলেও আদতে এগুলো পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং একে অপরের পরিপূরক। যেমন, একটা কার্যকর রাষ্ট্র নিজেদের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিলে সেই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত শিক্ষার্থীরা যথাযথ পেশা বেছে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ পেতে পারে, যা তাদের অভিভাবকদেরও লক্ষ্য এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই শিক্ষাকে যথাযথভাবে পরিচালিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং অভিভাবক উভয়কেই সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু এই তিনপক্ষের মধ্যে কখনো কখনো প্রয়োজনীয় যোগাযোগ স্থাপিত হয় না। ফলে তারা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ধোঁয়াশায় পরে, যা থেকে জন্ম হয় পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অসহযোগিতা। বর্তমান বাংলাদেশে এমনটাই ঘটছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি:
অভিভাবক এবং সাধারণভাবে সমাজের সকলের কাছে শিক্ষা হলো সর্বপ্রথমে ব্যক্তি ও পরিবারের নিরাপত্তা (economic security) এবং উন্নতির উপায়। বর্তমানে দেশে খুব কম মানুষের পক্ষেই শুধু পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ( যেমন, জমি, ব্যাংক ব্যালেন্স ইত্যাদি) ও পেশাভিত্তিক জ্ঞানের ( যেমন, পারিবারিক ব্যবসা, বংশগত পেশা, ইত্যাদি) উপর নির্ভর করে চলা সম্ভব। তাই সবাইকে স্কুলে গিয়ে যথাসম্ভব উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতেই হয়। কোন ব্যক্তির পক্ষে অন্তত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা না-করার চিন্তাটাও এখন প্রায় অসম্ভব। কেবল অর্থনৈতিক মঙ্গনের জন্যই নয়, শিক্ষা আমাদের সামাজিক, শারীরিক, মানসিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সুস্থতারও চাবিকাঠি। আর্থিক অবস্থার পাশাপাশি শিক্ষা আমাদের সামাজিক মর্যাদাও নির্ধারণ করে, যা আবার আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত। এজন্য শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বিষয়বুদ্ধিগত কি কি জ্ঞান দিচ্ছে তার পাশাপাশি সামাজিক ও নৈতিক দিকগুলোও অভিভাবকরা বিবেচনা করে। তারা নিশ্চিত হতে চায় যে, তাদের সন্তান স্কুলে গিয়ে সবধরনের প্রয়োজনীয় জ্ঞানই অর্জন করবে।
সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও আত্মিক উন্নতি:
নিজ নিজ সংস্কৃতিকে পরবর্তী জেনারেশনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পরিবারের পাশাপাশি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্কুল। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়ে সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ, ন্যায়বোধ, রীতিনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞানার্জন করে। স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন কীভাবে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার ওপর নির্ভরশীল, সেই শিক্ষাও পেয়ে থাকে। একইসাথে পরিবারের বাইরে অনাত্মীয়দের সাথে কীভাবে সামাজিকতা অনুযায়ী মেলামেশা করতে হয়, সে সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক ধারণা ও প্রশিক্ষণ লাভ করে। পাশাপাশি নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের জ্ঞানদানের মাধ্যমে স্কুল তাদের নিজেদের সমাজ নিয়ে গর্বিত হতে এবং সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলতে আগ্রহী করে তোলে। সুনির্দিষ্ট করে, স্কুলের এই ভূমিকার জন্যই রাষ্ট্র স্কুলের কারিকুলামের মধ্যে এমন সব বিষয় সংযুক্ত করে দেয় যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতির ধারণা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মরণের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবোধ এবং জাতির প্রতি কর্তব্যবোধ জাগ্রত করার প্রয়াস পায়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ইচ্ছের সাথে কখনো কখনো রাষ্ট্রের অভিপ্রায়ের মধ্যে অমিল দেখা দিলে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, যা আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে।
জাতীয় পরিচয় এবং নাগরিকতার শিক্ষা:
আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে জাতীয় পরিচয় এবং রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করা শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান কাজ বলে স্বীকৃত। আধুনিক রাষ্ট্রের আবির্ভাবের পর থেকেই স্কুলের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতিনীতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষা, ইত্যাদি বিষয়ে নানা বয়ান চালু করা হয় এবং এগুলোর ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়ের গৌরবের সাথে পরিচিত করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়, রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে দায়বদ্ধতা তৈরি হয় এবং রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যবোধ বৃদ্ধি পায়। এজন্য প্রত্যেক জাতিরাষ্ট্রেই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যবিষয়ক ধ্যানধারণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেগুলো প্রায়ই শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে অভিভাবকদের নিজস্ব চিন্তাভাবনার থেকে আলাদা হয়ে থাকে। কারণ, তাদের চিন্তাভাবনা মূলত ব্যক্তি ও পারিবারিক পরিসরে সন্তানদের ভালোমন্দ নিয়েই সম্পর্কিত থাকে, যেখানে রাষ্ট্রের নজর থাকে শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করা যারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থের পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থকেও প্রাধান্য দিবে।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলমান বিতর্কের প্রধান বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কারিকুলাম থেকে পরীক্ষাপদ্ধতি তুলে দেওয়া এবং স্কুলের বাইরে পারিবারিক ও সামাজিক পরিসর থেকে শেখা যায় এমন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা। বছরে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে এতদিন ধরে চলে আসা মূল্যায়নের বদলে নতুন যে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, তা সহজেই ফাঁকি দেওয়া সম্ভব বলে অভিভাবকদের মধ্যে এর কার্যকারিতা নিয়ে যে সন্দেহ, তা একেবারেই অমূলক নয়। আর এক্সট্রাকারিকুলার হিসেবে রান্না করা, নানা খেলাধুলা করার মধ্য দিয়ে স্কুলের বইপাঠের সময়কে সংকুচিত করে ফেলার কারণে সন্তানদের বিভিন্ন বিষয়ের বেসিক জ্ঞানটুকু যথেষ্ট পরিমাণে হবে কিনা তা নিয়েও অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা যথাযথ। সবথেকে বর্ব বিষয় হলো, প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে স্কুলের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিবারকেও যথেষ্ট পরিমাণে সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে তাদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে, যা ফিনল্যান্ড বা অন্যান্য উন্নত দেশের জন্য সম্ভব হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় অসম্ভব।
অতএব, চলমান বিতর্ক নিরসনের জন্য অভিভাবকদের সাথে খোলামনে আলোচনায় বসতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনায় নিয়োজিত সরকারি বিভাগসমূহকে। সেইসাথে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সাথে বাংলাদেশের বাস্তবতার ভিত্তিতে আলোচনা করতে হবে শিক্ষানীতি ও বাস্তবায়নের উপায়গুলোকে। সবশেষে, সকল পক্ষের মতামত আমলে নিয়ে শিক্ষাপদ্ধতির যথাযথ পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে।
হাসান মাহমুদ : শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান, লিবেরাল আর্টস বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, কাতার
মন্তব্য করুন