শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২
শরীফ শেখ
প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪, ০৩:৫২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বাঙালির সিনেমাপ্রীতি এবং আমাদের হারানো সংস্কৃতি

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

‘শহরবাসী সাবধান ! শহরে এসেছে এক নতুন পাগল। নাম তার ‘মনা পাগলা’। মনা পাগলা ছড়িয়ে পড়ছে শহরের অলিতে গলিতে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায়। এ পাগল হাসায়, কাঁদায়। মনা পাগলা এসেছে আপনার প্রিয় শহরের প্রিয় প্রেক্ষাগৃহ মমতাজ সিনেমায়।’ তারপর মাইকে শোনা যায় মনা পাগলা ছবির ট্রেলার থেকে সংলাপ, গান ইত্যাদি।

এটা আশির দশকে সিরাজগঞ্জ শহরে একটি নতুন সিনেমার বিজ্ঞাপন। রিকশা হুডের ওপর সামনে পেছনে মুখ করা দুটি মাইক। দুপাশে চাকার ওপর হুডের পাশ দিয়ে দুটো বড় রঙিন সিনেমার পোস্টার। রিকশাওয়ালা প্যাডল মেরে চলে যাচ্ছেন শহরের প্রধান প্রধান সড়ক পথ দিয়ে। রিকশার সিটে বসা বিজ্ঞাপন প্রচারকারী মাইক্রোফোন হাতে মুখের কাছে নিয়ে ধারাবর্ণনা দিচ্ছেন মমতাজ সিনেমা হলে সামনের শুক্রবার থেকে চলবে ছায়াছবি ‘মনা পাগলা’। এই ছায়া নায়ক ছিলেন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা হিসেবে পরিচিত টেলি সামাদ। নায়িকা রাখী। এটিএম শামসুজ্জামানসহ অন্যরা। পরিচালনায় ছিলেন কাজী হায়াত।

এক সময় এরূপ সিনেমার বিজ্ঞাপন বা আগমনবার্তা এদেশের সব শহরেই শোনা যেত। আর ছিল ঘরে ঘরে ওয়ান ব্যান্ড রেডিও। রেডিওতে ছিল সব নতুন নতুন সিনেমা নিয়ে তৈরি ট্রেলার বিজ্ঞাপন। প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী মাজহারুল ইসলাম এ সমস্ত বিজ্ঞাপনে ভয়েস দিতেন রেডিওতে। খুব ভালো লাগত স্কুল-কলেজে পড়ুয়া বয়সী আমাদের সবার। শহরে গিয়ে সব সময় সিনেমা দেখা সঙ্গতির মধ্যে না থাকলেও অসুবিধে নেই। এসব রেডিওতে শুনেই অনেক আনন্দ লাভ হতো। সিনেমার কাহিনি, নায়ক নায়িকা, ভিলেন, কলাকুশলী সব শ্রোতাদের মুখস্থ হয়ে যেত।

সত্তরের দশকে বিয়ের সময় জামাইকে একটা ওয়ান ব্যান্ড রেডিও তো দিতই। জামাই ক্ষেতের আলপথ দিয়ে শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার পথে বা শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পথে সাথে রেডিও বাজাতে বাজাতে যেত। গ্রামের কিষাণরাও ক্ষেতের আলে রেডিও রেখে গান শুনত আর ক্ষেত নিড়ানি দিত। গ্রাম্য বধূরা নৌকায় করে নাইয়োর যাওয়ার পথে একটা ওয়ান ব্যান্ড ট্রানজিস্টার নায়ের পাটাতনের ওপর বাজতে থাকত। হায়, কোথায় গেল সেসব অকৃত্রিম বিনোদনকাল।

মনা পাগলা ছবিটা দেখা হয়নি কিন্তু বিজ্ঞাপনের কথাটা ঠিক মনে আছে। যশোরের মণিহার সিনেমা বিরাট নামকরা ছিল। বিভিন্ন শহরে গেলে সেই শহরে সিনেমা দেখার খুব শখ হতো। ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন পাবনা শহরের বাণী হলে একটি পুরাতন ছবি ‘স্বরলিপি’ দেখেছিলাম। অসাধারণ সিনেমা। ভারতীয় ‘দেয়া নেয়া’ ছবির মতো কাহিনি। কিন্তু এতটাই ভালো যে, কোনটা কার অনুকরণে বানানো হয়েছে তা বলা কঠিন। ফতেহ লোহানী, রাজ্জাক, ববিতা, সুলতানা, আশীষ কুমার লোহ, আনোয়ারা দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন ছবিটিতে।

১৯৭৮ সালে ইবনে মিজান পরিচালিত ‘শাহজাদা’ ছায়াছবিটি দেখেছিলাম দিনাজপুর শহরের মডার্ন হলে ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা শেষ করে। আমরা চার বন্ধু, আমি, শহীদুল, নাজমুল, জিন্নাতুন নাহার, আখতারী এবং শহীদুলের ছোটবোন মল্লিকা। সঙ্গে ছিলেন শহীদুলের বড় ভাই, আমাদের ডালিম ভাই। ডালিম ভাই তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

রেডিওতে সিনেমার ট্রেলার এর পাশাপাশি মফস্বলের সব সিনেমা হলেই নতুন সিনেমা রিলিজকে কেন্দ্র করে রিকশায় রঙিন পোস্টারসহ মাইকে বিজ্ঞাপন হতো। এখন আর মফস্বল শহরগুলোতে সিনেমার বিজ্ঞাপন হয় না। বিজ্ঞাপন হবে কী করে, সিনেমা হলই নেই। যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন দুই বন্ধু আমি আর মোজাম্মেল বাইসাইকেলে করে স্কুল থেকে ১৪ মাইল(২৩ কিলোমিটার) দূরের ঠাকুরগাঁও শহরে গিয়ে বলাকা টকিজে সিনেমা দেখে এসেছিলাম। ছবির নাম ছিল ‘সুন্দরী’। হিরো-হিরোইন ইলিয়াস কাঞ্চন, ববিতা। সব স্বপ্ন মনে হয় এখন। প্রায় বছরখানিক আগে ঠাকুরগাঁও গিয়ে সেই পুরাতন হলটি দেখে এলাম। দেখলাম সেই ভবনটি এখনো আছে, তবে পরিত্যক্ত অবস্থায়। তার পরিবর্তে সার্কিট হাউসের সামনের দিকে একই নামে নতুন হল আছে, কিন্তু হল বন্ধ, সিনেমা চলে না।

নব্বইয়ের দশকেও ঢাকার মধুমিতা, গুলিস্তান, আজাদ, অভিসার, স্টার, মুন, সনি, আনন্দ, ছন্দ ইত্যাদি হলে সিনেমা দেখেছি। ওয়াইজঘাটের মুন হলটি চোখের সামনে উঠে গিয়ে বড় মার্কেট হয়ে গেল। জোনাকি হল বন্ধ, রাজমণি হল কয়েকমাস আগে ভেঙে ফেলা হলো। ইদানীং কিছু সিনেপ্লেক্স হয়েছে ঢাকায়। মফস্বলে সেরকম হয়েছে বলে জানা নেই।

সময় এত কমে গেছে, ব্যস্ততা এত বেড়ে গেছে, হলে গিয়ে সিনেমা দেখার ফুরসতই মেলে না। ইচ্ছে করে শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে প্রতিদিন সবকটি মঞ্চ নাটক দেখি। কিন্তু সময় কই। তারপর আর্থিক দিকটা তো আছেই। আর ঢাকা শহরে মঞ্চনাটক মূলত শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক। বেইলি রোডের মহিলা সমিতিতে মাঝে মাঝে হয়। পাশাপাশি আগে গাইড হাউস মিলনায়তনেও হতো, এখন আর হয় না। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, রামপুরা বা আরও দূরবর্তী কোনো এলাকা থেকে ট্রাফিকজ্যাম ঠেলে যাতায়াত করে কে আসতে চাইবে শিল্পকলা একাডেমিতে।

কয়েক বছর আগে আমাদের এক বান্ধবী বলেছিল, যেন শ্যামলী সিনেপ্লেক্সে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ সিনেমাটি সবাই মিলে দেখার আয়োজন করি। বউকে বললাম। সে এককথায় রাজি। ছেলেমেয়েদের বললাম। তারাও রাজি, কিন্তু সন্ধ্যায় দুজনের কোচিং মিস হয়ে যায়। শেষমেশ কোচিং বাদ দিয়েই সিনেমা দেখার আয়োজন করলাম। বউ খোটা দিতে ছাড়ল না, ‘বান্ধবীর প্রস্তাব বলে কথা, কোচিং টোচিংয়ের গুরুত্ব কী আর আসবে মাথায়?’ উত্তরা থেকে আরেক বন্ধু এলো সপরিবার। সেবার তিন পরিবার মিলে সন্ধ্যায় সিনেমাটা দেখেছিলাম। শ্যামলী সিনেপ্লেক্সে। হুমায়ূন আহমেদ-পত্নি মেহের আফরোজ শাওন নাট্যশিল্পী হিসেবে সবার কাছেই সুপরিচিত। সিনেমা পরিচালনাও ভালো করেছেন। ৩টি গান বেশ ভালো। একটি গানে শাওন নিজেই প্লেব্যাক করেছেন। অভিনয় করেছেন আজাদ আবুল কালাম, তানিয়া, মাহিয়া মাহি, রিয়াজ ও অন্যরা।

কিছু কিছু ভালো ভালো সিনেমা যে হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু ভালো সিনেমা হল নেই। ঢাকায় মুষ্টিমেয়সংখ্যক সিনেপ্লেক্স। ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরে এসব সিনেপ্লেক্স নেই। দর্শককে হলমুখী করতে হবে। সিনেমা শিল্প আমাদের পুরাতন সংস্কৃতির অংশ। ষাটের দশকে বাঙালি দল বেঁধে সবান্ধব সপরিবার সিনেমা দেখেছে। বাংলা, উর্দু, হিন্দি সিনেমা। তখন ঢাকায়ই নির্মিত হয়েছে বাংলার সঙ্গে উর্দু সিনেমা। এখনো ইউটিউবে ঢাকা উর্দু সিনেমা লিখে সার্চ দিলে দেখবেন সে সময়কার অনেক জনপ্রিয় উর্দু সিনেমা। এসব উর্দু সিনেমায় অভিনয় করেছেন শবনম, রহমান, রাজ্জাক, শাবানা, খলিল, মোস্তফা, সুভাষ দত্ত, আনিসসহ আরও অনেক বাঙালি অভিনয়শিল্পী। বলিউডের জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমাও ঢাকার হলে দর্শক দেখেছে। তখন তো ভিডিও প্লেয়ার ছিল না ইউটিউব তো বহু দূরের কথা।

আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলগুলোতে সিনেমাশিল্পে অবস্থা জানা নেই। তবে কলকাতা শহরে দুহাজার ১২ থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত কূটনীতিক কর্মব্যপদেশে থাকাকালীন দেখেছি, সেখানে প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন সিনেমা রিলিজ হতো। সেখানে বিভিন্ন সিনেপ্লেক্সে গিয়ে হলভর্তি দর্শক সিনেমা দেখে। সেখানে অবশ্য বলিউডের হিন্দি সিনেমাও খুব চলে। ফলে হিন্দি সিনেমার সঙ্গে বাংলা সিনেমা পাল্লা দিয়ে চলে।

ইন ফ্যাক্ট বাংলাদেশ আমলের প্রথম দশকে অর্থাৎ সত্তরের দশকেও বাঙালি মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই, বিশেষত মফস্বল শহুরে পরিবারের সদস্যরা সপরিবার হলে সিনেমা দেখত। হলে গিয়ে সিনেমা দেখার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেল আশির দশকে বেশ কিছু সিনেমায় ভালগারিজম, কাটপিস ইত্যাদির অনুপ্রবেশের ফলে এবং তারপরে ভিসিপি আসার পর। কিন্তু বাঙালির সিনেমা দেখার অভ্যেস বা খায়েশ কিন্তু একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এই ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফরম আসার পরেও। এর প্রমাণ ঢাকার বিভিন্ন সিনেপ্লেক্স বা মাল্টিপ্লেক্সে ভাল কোনো সিনেমা রিলিজ হলে উপচেপড়া ভিড় হয়। টিকেটই পাওয়া যায় না।

আমার মনে হয়, চলচ্চিত্র পরিচালকদের যেমন দায়িত্ব আছে ভালো ভালো সিনেমা তৈরি করে দর্শক রুচি মানস গঠনে অবদান রাখা, তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে হলে গিয়ে সিনেমা দেখে ভালো নির্মাতাকে উৎসাহ প্রদান করা। ভালো সিনেমা দেখা উচিত আর মন্দ, বাজে সিনেমা বর্জন করা উচিত। পরিচালক প্রযোজককে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এটিও কিন্তু কম গুরুত্ববহ নয় সামাজিক কাজ হিসেবে। তাছাড়া সপরিবার সবান্ধব একটা আড্ডাও তো হয়। নির্মল আড্ডা স্বাস্থ্যকর।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১০

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

১১

সুদ দিতে না পারায় বসতঘরে তালা, বারান্দায় রিকশাচালকের পরিবার

১২

দেশ বাঁচাতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে : চরমোনাই পীর

১৩

এএসপির বাসায় চাঁদাবাজি-ভাঙচুর, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৪

জেলের জালে বড় ইলিশ, ৯ হাজারে বিক্রি 

১৫

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন নিয়ে নতুন নির্দেশনা

১৬

আগামী সংসদ প্রথম তিন মাস ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব

১৭

ধরলার তীব্র ভাঙন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি

১৮

নেতা ও ভোটারের জবাবদিহিই হবে শ্রেষ্ঠ সংস্কার : মঈন খান

১৯

পাপের ফল ওদের ভোগ করতেই হবে : রাশেদ খান

২০
X