মাওলানা জুনায়েদ শামসী
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:১৩ এএম
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ফুক্বাহায়ে কেরামের ভাষ্যে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

আজ ১২ রবিউল আউয়াল। ইতিহাসের এই মাসের সোমবার দিনে পৃথিবীর বুকে আগমন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মোহাম্মদ (সা.)। আর প্রতি বছর ওই দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে প্রচলিত নিয়মে যে উৎসব পালন করা হয়, তাকে ঈদে মিলাদুন্নবী বলে।

ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের প্রচলিত নিয়ম হলো, মানুষদের একত্রিত করে সভা-সমাবেশ জশনে-জুলুস, র‌্যালি, শিরনি, ইত্যাদির আয়োজন করা। তবে একদল মানুষ ঈদে মিলাদুনন্নবী পালনের ফজিলত বর্ণনা করলেও, আরেকদল এটিকে বিদআত হিসেবে চিহ্নিত করেন। অর্থাৎ নবীজির (সা.) মিলাদ পালনীয় না আলোচ্য, এই জায়গায় বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় মতানৈক্যের জন্ম হয়েছে।

একদল মনে করেন মিলাদুন্নবী পালনীয়, আরেকদল মনে করেন নবীজির (সা.) মিলাদ শুধু আলোচ্য। মূল সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে নবীজির (সা.) জন্ম তারিখ ও জন্মদিনে কী আমল ছিল তাঁর (সা.) এবং মিলাদুন্নবী উৎসবের সূচনা সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

নবীজির (সা.) জন্মসন সস্পর্কে কিছুটা ঐকমত্য পাওয়া গেলেও জন্মতারিখ সম্পর্কে বিস্তর মতানৈক্য বিদ্যমান। মক্কায় হস্তি যুদ্ধের বছর নবীজি (সা.)- এর জন্ম হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন। তবে, এযাবৎ কোনো ইতিহাসবেত্তা স্পষ্ট ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো তারিখ নির্ধারণ করেননি। হাঁ, রবিউল আউয়াল মাসের ২, ৮, ৯, ১০ ও ১২ তারিখসংক্রান্ত ৫টি মতামত ইতহাসবিদগণ উল্লেখ করেছেন। এসবের মধ্যে অধিক প্রসিদ্ধ মতামত হিসেবে আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার গ্রন্থাকার ৮ রবিউল আউয়ালের কথা উল্লেখ করেছেন।

আর ১২ রবিউল আউয়াল যে তারিখটি নবীজির (সা.) জন্ম তারিখ হিসেবে আমাদের লোকসমাজে প্রসিদ্ধ, এটা ‘তারিখ গবেষকদের মতে দুর্বল মত। এই ইখতিলাফ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, নবী (সা.)- এর জন্মের সন নির্ধারিত হলেও জন্ম তারিখ নির্ধারিত নয়। যদি জন্ম তারিখ নির্ধারিত না হয়, তাহলে জন্মোৎসব কোন তারিখে পালন করবেন; এই প্রশ্ন তো রাখাই যায়।

নবীজি (সা.) প্রতিবছর নিজের জন্মোৎসব পালন করতেন কি না— এই প্রশ্নের জবাব জানতে নিজের জন্মদিনে নবীজির আমল কী ছিল, এটা জানা দরকার। আবু কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) সোমবার দিন রোজা রাখতেন। কেন রোজা রাখতেন এই জিজ্ঞাসার জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, আমি সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেছি এবং আমার ওপর প্রথম ওহী সোমবার দিন অবতীর্ণ হয়েছে। (মুসলিম : ১১৬২)

এই হাদিসের ব্যাখায় আমরা দুটি জিনিস দেখতে পাই—

এক. নবীজি তাঁর জন্মদিনে রোজা রাখতেন নিজে একা। কখনো কোনো সাহাবিকে রোজা রাখতে নির্দেশ দেননি।

দুই. নবীজি (সা.) বছরে কোনো এক নির্ধারিত তারিখে রোজা রাখতেন না বরং প্রতি সোমবার কৃতজ্ঞতার জায়গা থেকে রোজা রাখতেন।

হাদিসটি থেকে ফুক্বাহায়ে কেরাম বলছেন, নির্ধারিত কোনো তারিখে নবীজি (সা.) জন্মোৎসব পালন করতেন না এবং সাহাবায়ে কেরামকে জন্মদিন পালনের জন্য কোনো নির্দেশ দেননি। যদি মিলাদুন্নবী পালনীয় হতো, তাহলে নবীজি (সা.) তাঁর সকল সাহাবায়ে কেরামদের জন্মোৎসব পালনের নির্দেশ দিতেন। নিজেও নির্ধারিত তারিখে জন্মোৎসব পালন করতেন।

আরও পড়ুন : যে ৫ ব্যক্তির দোয়া কখনোই কবুল হয় না

আরও পড়ুন : কার মৃত্যু কীভাবে হবে তা কি পূর্বনির্ধারিত, নাকি ব্যক্তির কর্মফলের ওপর নির্ভর?

কিন্তু নবীজি (সা.), সাহাবায়ে কেরাম এবং খায়রুল কুরুনের কারো আমলের ওপর অনুসন্ধিৎসা চোখে নজর দিলে নবীজির (সা.) জন্মোৎসব পালনের কোনো নজির পাওয়া যায় না। এটা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ঈদে মিলাদুন্নবী খায়রুল কুরুন পরবর্তী নবআবিষ্কৃত একটা বিষয়।

প্রচলিত ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের সূচনাকাল

ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের সূচনাকাল হলো ৬০৪ হিজরী। বাদশাহ মুজাফফর উদ্দীন এর নির্দেশে মিলাদুন্নবী পালনের প্রচলন হয়। মুজাফফর উদ্দীন জন্মোৎসব পালনের সূচনাকারী। তাফসিরবিদ ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, বাদশাহ মুজাফফর উদ্দীন রবিউল আউয়াল মাসে নবীজির জন্মোৎসব পালন করতেন, একটি মাহফিলের আয়োজন করতেন। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১৩/১২৭)

এই বাদশাহ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। তারা মুজাফফর উদ্দীনকে অপচয়কারী এবং মাজহাব বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আরেকটা বক্তব্য ইতিহাসের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, বাদশাহ মুজাফফর উদ্দীন মাওসিল শহরে উমর বিন হাসান নামে এক ওলীর নির্দেশে ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের সূচনা করেছিলেন। তিনি প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানের নামে লাখ লাখ রুপি খরচ করতেন। (লিসানুল মিজান : ৪/২৯৬)

উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, নবীজির (সা.) জন্মদিন নির্ধারিত নয়, জন্মোৎসব পালন করতেন না তিনি (সা.)। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের নামে কেক কেটে উৎসব উদযাপন হয়। এ ছাড়া মারহাবা ইয়া মুসতাফা স্লোগানসহ জশনে-জুলুস-এর মিছিল শোডাউন বের করা হয়। যার সঙ্গে নবীজির জন্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব কাজ কখনো ইসলাম সমর্থন করে না। নবীজির (সা.) ভালোবাসায় যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের থেকে নবীজির (সা.) জন্মোৎসব পালনের কোনো হদিস মেলে না।

প্রচলিত পদ্ধতিতে মিলাদুন্নবী পালন কি বৈধ?

আল্লামা নাসিরুদ্দিন শাফেয়ী বলেন, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা বৈধ নয়। কারণ কথিত উৎসব খায়রুল কুরুন-এর পরের যুগে শুরু হয়েছে। মিলাদুন্নবী উৎসবকে পূর্ববর্তী আলেমরা অহেতুক বলেছেন, আমরা এটার অনুসরণ করতে পারি না। (ফতোয়ায়ে রশিদিয়া : ১/১৯৩)

এ ছাড়া আরও অসংখ্য আলেম প্রচলিত নিয়মে বারো রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী পালনকে বিদাত বলে ফতোয়া প্রদান করেছেন।

লেখক : শিক্ষক, জামেয়া দারুল উলুম কানাইঘাট, সিলেট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সন্ধ্যায় মাঠে নামছে বাংলাদেশ, খেলা দেখবেন যেভাবে

মোদি যাচ্ছেন না যুক্তরাষ্ট্রে

সিপিএলে আবারও হতাশ করলেন সাকিব

বন্দরে বরফ সংকট, জেলেরা দিশাহারা 

৪৭তম বিসিএস প্রিলির প্রবেশপত্র ডাউনলোড শুরু, পরীক্ষা ১৯ সেপ্টেম্বর

এক ঘটনাতেই তোলপাড় ইন্দোনেশিয়া, প্রতিবেশীদের সমর্থন

সীমান্ত থেকে ছাত্রলীগ নেতাকে ধরে ফেলল জনতা

সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ

‘বাগি ফোর’ নিয়ে বিপাকে সেন্সর বোর্ড

মেসিদের জন্য বড় দুঃসংবাদ, থুতু কাণ্ডে বড় শাস্তি পেলেন উরুগুইয়ান তারকা

১০

ঢাকার বাতাস সহনীয়, বায়ুদূষণের শীর্ষে কিনশাসা

১১

সম্পর্ক সুন্দর রাখার ৯ সহজ উপায়

১২

আবারও ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব, পুলিশের তদন্ত শুরু

১৩

চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে ৫৪তম জশনে জুলুস

১৪

নতুন রুপে শাহরুখ

১৫

সবসময় ক্লান্ত লাগে? সহজ সমাধান বিট কেভাস

১৬

নৌকাডুবিতে মায়ের মৃত্যু, মেয়ে নিখোঁজ

১৭

পাহাড়ের বুকে সৌদি আরবের ফাইভ স্টার হোটেল 

১৮

সারাদিন সতেজ থাকতে সকালে করুন এই সহজ ব্যায়াম

১৯

ম্যাজিস্ট্রেট আসার খবরে পালালেন বর-কনে

২০
X