ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ পরম কাঙ্ক্ষিত লড়াইগুলোর একটি। এই ম্যাচে শুধু দুই দেশের রাজনৈতিক বৈরিতার আবহই থাকে না, থাকে বাণিজ্যিকভাবে বিপুল অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টা। কিন্তু গত এক দশক ধরে এই দুটি দেশ খেলছে না দ্বিপাক্ষিক কোনো সিরিজ। ফলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই দলের মুখোমুখি হওয়ার একমাত্র ভরসা বহুজাতিক টুর্নামেন্ট, যেমন বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ, ইত্যাদি।
এবারের এশিয়া কাপে শুরুতে আয়োজক ছিল পাকিস্তান। ভারত পাকিস্তানে যেতে রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে সহআয়োজক হয় শ্রীলঙ্কা। তার মানে ভারত তাদের সব ম্যাচ খেলবে শ্রীলঙ্কায়। কিছু ম্যাচ হবে পাকিস্তানে। ছয় দলের এই টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ যত বেশি করা যায়, সূচি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সব করার চেষ্টা করেছে আয়োজকরা। কিন্তু বিধিবাম, সব চেষ্টাই বৃথা। সুপার ফোর থেকেই বিদায় নিয়েছে পাকিস্তান। শেষ পর্যন্ত ফাইনাল হচ্ছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে।
ফাইনালসহ গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু করে সুপার ফোর, সব মিলিয়ে পাক-ভারত লড়াইটা যেন তিনবার হয়, সেই চেষ্টা ভালোমতো করেছে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল। গ্রুপ পর্বে ও সুপার ফোরে সফল হলেও শেষটা যেন বিষাদে ভরা।
আয়োজক তথা এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল কী কী চেষ্টা করেছিল পাক-ভারত ফাইনাল হওয়ার জন্য, তা একটু দেখে নেওয়া যাক। শুরুতেই গ্রুপ পর্বের দিকে তাকানো যাক। দুই গ্রুপে মোট ছয়টি দল। এ গ্রুপে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে লিলিপুট নেপাল। বি গ্রুপে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। একটি গ্রুপ থেকে সুপার ফোরে যেহেতু যাবে দুটি করে দল, তাই বাড়তি ঝুঁকি নেওয়া হয়নি। পাকিস্তান-ভারতের মতো দলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে নেপালের নাম। এখানে নেপালের পরিবর্তে যদি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা কিংবা আফগানিস্তানের মতো দল থাকত, তাহলে হিসাবটা জটিল হতে পারত। অথচ সেই পথে হাঁটেনি আয়োজকরা।
গ্রুপ পর্বের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ পূর্ণতা পায়নি বৃষ্টির কারণে। গত ২ সেপ্টেম্বর পাল্লেকেলেতে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল এই দুটি দল। আগে ব্যাট করতে নেমে ৪৮.৫ ওভারে ২৬৬ রানে অলআউট ভারত। জবাবে বৃষ্টির কারণে ব্যাট করতে পারেনি পাকিস্তান। ম্যাচ হয় পরিত্যক্ত, পয়েন্ট হয় ভাগাভাগি।
তারপরও নেপালের মতো খর্ব শক্তির দলকে পাশ কাটিয়ে সুপার ফোরে নাম লেখায় ভারত ও পাকিস্তান। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই ছিল বৃষ্টির দাপট। আর তাই এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল গ্রহণ করে অনৈতিক এক সিদ্ধান্ত। বৃষ্টির কারণে ফাইনালে যেতে ভারত ও পাকিস্তানের যাতে অসুবিধা না হয়, সুপার ফোরে তার জন্য ঘোষণা করা হয় রিজার্ভ ডে। এই সুবিধা শুধু ভারত ও পাকিস্তান ম্যাচের জন্যই। বাকি দুই দল বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার জন্য প্রযোজ্য নহে।
এসিসির এমন সিদ্ধান্তের পর সমালোচনা হয়েছে অনেক। সবার আগে প্রশ্নটা তুলেছিলেন বাংলাদেশের লঙ্কান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা ঠিক নয়। আমাদের ম্যাচেও অতিরিক্ত একটা দিন দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। ওরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি আমাদের মতামত চাইত, তা হলে নিশ্চয়ই দিতাম।’
ভারতের সাবেক পেসার ভেক্টটেশ প্রসাদ একটি টুইট করেছিলেন। তাতে মিশে ছিল অভিশাপের ছায়া। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘যদি এই সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তা হলে চূড়ান্ত লজ্জাজনক। আয়োজকরা প্রতিযোগিতা নিয়ে ছেলেখেলা করছেন। একটা প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই দুটো দলের জন্য আলাদা নিয়ম হতে পারে না। যদি সঠিক বিচারের কথা বলেন, তা হলে আমি চাইব প্রথম দিন এবং রিজার্ভ দিন দুটোই যেন বৃষ্টিতে ভেস্তে যায়। দ্বিতীয় দিন যেন আরও বেশি বৃষ্টি হয়। এই নোংরা পরিকল্পনা যাতে কোনোভাবে সফল না হয় সেটাই চাই।’
যদিও শেষ পর্যন্ত প্রসাদের অভিশাপ লাগেনি। ম্যাচটি নিষ্পত্তি হয়েছিল বটে, তবে রিজার্ভ ডে মিলিয়ে দুই দিনে। কারণ প্রথম দিনে খেলা শেষ করা যায়নি বৃষ্টির কারণে। ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর মিলিয়ে অনুষ্ঠিত ম্যাচে ভারত জিতেছিল ২২৮ রানের ব্যবধানে। ভারতের করা দুই উইকেটে ৩৫৬ রানের জবাবে পাকিস্তান অল আউট হয়েছিল মাত্র ১২৮ রানে।
বাংলাদেশের সঙ্গে জিতলেও ভারতের কাছে পরাজয়ে শেষ ম্যাচটি পাকিস্তানের জন্য ছিল অঘোষিত সেমিফাইনাল। রুদ্ধশ্বাস যে ম্যাচে বাজিমাত করে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুই উইকেটের মহাকাব্যিক জয়ে ফাইনালে জায়গা করে নেয় তারুণ্যে ঠাসা দলটি।
শ্রীলঙ্কার এই ফাইনালে উঠে আসা কাকতালীয় নয়। হতে পারে দলটি তরুণ। কিন্তু এশিয়া কাপের ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। এর আগে অনুষ্ঠিত ১৫টি এশিয়া কাপের মধ্যে ১১ বারই ফাইনাল খেলেছে শ্রীলঙ্কা। এবার সেই চোটজর্জর দলটিই তারুণ্যের চমকিত আবহে দেখিয়েছে তাদের কারিকুরি। যোগ্য দল হিসেবে উঠেছে ফাইনালে। তাদের ফাইনালে উঠে আসার প্রক্রিয়াকে কেউ ফ্লুক বলবে না অন্তত।
তবে শ্রীলঙ্কার এই ফাইনালে উঠে আসায় যতটা না রক্তক্ষরণ হয়েছে পাকিস্তানের তার চেয়ে বেশি হয়েছে যেন এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের কর্তা ব্যক্তিদের। কারণ এশিয়া কাপের মতো আসরে পাক-ভারত ফাইনালটা খুব করে চেয়েছিল তারা। এর জন্য দৃষ্টিকটু গ্রুপিং থেকে শুরু করে রিজার্ভ ডে রাখার মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্তও তারা নিয়েছিল। কিন্তু শেষটা কী হলো, তা সবারই জানা।
মন্তব্য করুন