বায়ার্ন মিউনিখে আসার আগে ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেইনের নামে ছিল না কোনো ক্লাব কিংবা আন্তর্জাতিক শিরোপা। বারবার ফাইনালে গিয়ে হতাশায় ভরা মুখে ফিরেছেন। সমালোচকদের তির্যক মন্তব্য যেন সঙ্গী হয়ে উঠেছিল তার। কিন্তু এবার সেই অধ্যায় শেষ। অবশেষে নিজের শিরোপা খরা কাটালেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক—বুন্দেসলিগা জয় করলো তার দল বায়ার্ন মিউনিখ, আর কেইন পেলেন কাঙ্ক্ষিত সেই ‘মেজর ট্রফি’।
মাঠের বাইরে থেকেও উৎসব
আক্ষেপের বিষয়, শিরোপা নিশ্চিত করা ম্যাচে ছিলেন না কেইন। পাঁচটি হলুদ কার্ড পাওয়ায় তিনি লিপজিগের বিপক্ষে ম্যাচে ছিলেন নিষিদ্ধ। খেলা দেখতে হয়েছিল গ্যালারি থেকে। “এটাই যেন আমার ক্যারেক্টারের প্রতিচ্ছবি,” মজা করে বলেছিলেন ৩১ বছর বয়সী এই তারকা, “কিন্তু চিন্তা কোরো না, আমি সবার চেয়ে জোরে উদযাপন করব!”
খেলা শেষ হতেই তিনি নেমে এসেছিলেন সাইডলাইনে। তবে বায়ার্নের ট্রফি জয় তখনও নিশ্চিত হয়নি। অবশেষে পরদিন লেভারকুজেন যখন ফ্রাইবুর্গের বিপক্ষে ড্র করে, তখন নিশ্চিত হয় বায়ার্নের শিরোপা—আর শুরু হয় কেইনের শিরোপা উৎসব। ইংল্যান্ড সতীর্থ এরিক ডায়ার ও বায়ার্নের অন্যান্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে 'We are the Champions' গান গেয়ে উদযাপন করেন কেইন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পুরস্কার
এক সময় টটেনহ্যামে কিশোর বয়সে যিনি ছিলেন না সেরা প্রতিভা, তিনিই হয়েছেন ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ গোলদাতা। কিন্তু ২০১০ সালে পেশাদার চুক্তি করার পর লেইটন ওরিয়েন্ট, মিলওয়াল, লেস্টার ও নরউইচে ধারে খেলেও কোথাও শিরোপা জেতা হয়নি।
টটেনহ্যামের জার্সিতে ৪৩৫ ম্যাচে ২৮০ গোল করেও শিরোপা অধরা ছিল। ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ইউরো ফাইনালেও ট্রফির দেখা মেলেনি। ক্লাব ক্যারিয়ারে তিনবার প্রিমিয়ার লিগ গোল্ডেন বুট জিতলেও ছিল না শিরোপার গৌরব।
ব্যর্থতার গল্প বদলাল বায়ার্নে এসে
২০২৩ সালের আগস্টে যখন ১০০ মিলিয়ন ইউরোয় বায়ার্নে যোগ দেন, তখন মনে হয়েছিল এবার বুঝি মুকুট উঠছে মাথায়। কিন্তু হতাশা ঘিরেছিল শুরুটা। জার্মান সুপার কাপের ফাইনালে লিপজিগের কাছে হেরে যায় দল। পরে জার্মান কাপ থেকেও বিদায় নেয় তারা। এমনকি বুন্দেসলিগার টানা ১১ বছরের শিরোপাজয়ী দলটি লিগ টেবিলে নামে তৃতীয় স্থানে! চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও বিদায় নিতে হয় সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে হেরে।
‘মানুষ হাসাহাসি করেছিল, বলেছিল কেইন আসার পর বায়ার্নের হাত শূন্য,’ বলেন জার্মান ফুটবল বিশ্লেষক তাওফিক খালিল। কিন্তু এসব সমালোচনা মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন কেইন।
নতুন দেশে, নতুন জীবন
জার্মানিতে বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছেন কেইন। অক্টোবরফেস্টে যোগ দিয়েছেন, ভক্ত ক্লাব ঘুরেছেন, এমনকি জার্মান ভাষাও শিখছেন। ‘আমার বাচ্চারাই আমার আগে শিখে ফেলবে!’—মজা করে বলেছেন তিনি।
টমাস মুলার, কনরাড লাইমারের সঙ্গে গলফ খেলেন, এরিক ডায়ার তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সতীর্থদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, আর জার্মান সমর্থকরাও ভালোবেসেছে এই ইংলিশ তারকাকে।
মাঠে পারফরম্যান্স, আর চরিত্রে প্রশংসা
বুন্দেসলিগায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২৪ গোল করেছেন কেইন। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তার গোল সংখ্যা ৩৬, যার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রয়েছে ১১টি। শুধু গোল নয়, ১৫টি অ্যাসিস্টও করেছেন। প্রতি ৭২ মিনিটে একবার গোল বা অ্যাসিস্ট করেছেন—এক কথায় দুর্দান্ত।
‘সে যুদ্ধ করে, পরিশ্রম করে, গোল করে,’ বলেছেন বায়ার্নের সম্মানীয় সভাপতি উলি হোয়েনেস। ‘এটি ওর প্রাপ্য।’
ম্যানেজার ভিনসেন্ট কোম্পানির ভাষায়, ‘সে এখনো তরুণ খেলোয়াড়ের মতো দৌড়ায়, লড়াই করে।’
শেষমেশ অধরা স্বপ্ন ধরা দিল
ছয়টি ফাইনাল হেরে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পর অবশেষে পেলেন কাঙ্ক্ষিত ট্রফি। আর সেটি পেয়েই যেন যেন আরও চাঙ্গা হ্যারি কেইন। মাঠের পারফরম্যান্সে যেমন আগের মতোই ধারাবাহিক, তেমনি মাঠের বাইরে থেকেও একজন দায়িত্ববান, বিনয়ী এবং আদর্শ পেশাদার।
এবার হয়তো সমালোচকদের মুখে তালা লাগবে। কারণ হ্যারি কেইন এখন শুধুই একজন ‘বিশ্বমানের গোলদাতা’ নন, তিনি এখন একজন চ্যাম্পিয়ন।
মন্তব্য করুন