ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি যখন ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে, তখন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে ঘিরে নেওয়া হয়েছে নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থায়।
ইসরায়েলি হামলায় দেশটির সেনাপ্রধানসহ একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর থেকেই এই অতিরিক্ত সতর্কতা গ্রহণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধমাঠে যুক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
এই অবস্থায় খামেনিকে রক্ষা করতে গঠন করা হয়েছে একটি অভিজাত ও অতিসংরক্ষিত নিরাপত্তা ইউনিট- যার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন না এমনকি ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ কর্মকর্তারাও। তেহরানের সূত্র জানায়, এই ইউনিট এতটাই গোপন যে এর নাম, কাঠামো ও সদস্যদের পরিচয় পুরোপুরি অজানা রাখা হয়েছে।
৮৬ বছর বয়সী খামেনি বর্তমানে তার সব ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন। শুধু কয়েকজন বিশ্বস্ত সহকারীর সঙ্গেই তার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস সূত্রে জানা গেছে, এই পদক্ষেপ তার অবস্থান গোপন রাখতে নেওয়া হয়েছে, যেন কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা প্রযুক্তির সাহায্যে তাকে ট্র্যাক করা না যায়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সামরিক স্তরে অনুপ্রবেশ করেছে বলে তথ্য রয়েছে। এই আশঙ্কা থেকেই খামেনির নিরাপত্তা ইউনিটকে সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছে, যাতে কোনোভাবেই তা ভেদ করা না যায়।
প্রসঙ্গত, শনিবার (২৩ জুন) মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সমন্বয় করে ইরানের ৩টি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। এর মধ্যে একটি ছিল ফোরদোর ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র। এই হামলার পরই ধারণা করা হচ্ছে, খামেনিকে ‘বেইত রাহবারি’ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে একটি সুরক্ষিত বাংকারে।
সাধারণত তিনি তেহরানের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত কম্পাউন্ডেই অবস্থান করেন, সেখান থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও ভাষণ পরিচালনা করেন। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এখন তার অবস্থান অত্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে।
তেহরানের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, খামেনি ইতোমধ্যেই তার সামরিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় একাধিক বিকল্প নেতৃত্ব ঠিক করে রেখেছেন। কারণ, চলমান সংঘাতে তার ঘনিষ্ঠ সেনা ও প্রশাসনিক সহকারীদের প্রাণহানির আশঙ্কা প্রবল। গত সপ্তাহেই ১১ জন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও ১৪ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী ইসরায়েলের টার্গেটেড স্ট্রাইকে নিহত হয়েছেন।
খামেনি বহুদিন ধরেই ‘শহীদ হওয়ার’ সম্ভাবনার কথা বলে আসছেন। তার বিশ্বাস, ইসরায়েল তাকে হত্যা করতে চাইবেই- এমন বাস্তবতায় তিনি প্রস্তুত রয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি বলেছেন, খামেনিকে সরিয়ে ফেলাই এই সংঘাতের সমাপ্তির অন্যতম উপায় হতে পারে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ আরও একধাপ এগিয়ে তাকে ‘আধুনিক যুগের হিটলার’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, খামেনিকে বাঁচিয়ে রাখা মানবজাতির জন্য হুমকি।
খামেনিকে ঘিরে এই বিশেষ নিরাপত্তা কেবল একজন নেতার প্রাণরক্ষার বিষয় নয়, বরং তা ইরানের রাজনৈতিক কাঠামো এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তার অনুপস্থিতি বা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইরানে এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হতে পারে, যা গোটা অঞ্চলকে আরও অস্থির করে তুলবে।
মন্তব্য করুন