দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপজুড়ে নিপীড়িত ইহুদিদের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল ভূমধ্যসাগরের ছোট দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস। ইতিহাসের সেই পুরোনো অধ্যায়ের সঙ্গে আজকের একটি ঘটনা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে।
ইরান-ইসরায়েল সাম্প্রতিক সংঘাতের পর নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় একদল ইসরায়েলি নাগরিক আবারও সাইপ্রাসে পাড়ি জমাতে শুরু করেছেন। তবে এবার তাদের উপস্থিতি শুধুই নিরাপত্তাজনিত নয়- তারা জমি কিনছেন, বসতঘর তুলছেন, গড়ে তুলছেন নিজেদের নির্জন আবাসন।
এমন প্রেক্ষাপটে সাইপ্রাসজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ- এই দ্বীপ কি তবে ধীরে ধীরে আরেকটি ‘ফিলিস্তিনে’ রূপ নিতে চলেছে? খবর সাইপ্রাস মেইলের।
দেশটির বামপন্থি প্রধান রাজনৈতিক দল আকেল পার্টি এই প্রবণতাকে ‘ভূমি দখলের সূক্ষ্ম কৌশল’ বলে আখ্যা দিয়েছে। দলটির মহাসচিব স্তেফানো সরকারি সম্প্রচারমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সাইপ্রাস একটি ছোট দেশ, আর এর ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত। এখন যদি আমরা সতর্ক না হই, ভবিষ্যতে হয়তো নিজেদের জমিও নিজের হাতে থাকবে না।
আকেল পার্টি মনে করছে, ইসরায়েলিরা বিশেষভাবে সাইপ্রাসের সেনাঘাঁটির আশপাশের অঞ্চল, যেমন লারনাকা ও লিমাসোল এলাকাগুলোকেই টার্গেট করছে। এসব জায়গায় ইতোমধ্যে গেটেড কমিউনিটি, সিনাগগ ও জায়নবাদী স্কুল তৈরি হচ্ছে, যেখানে স্থানীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু লারনাকা জেলাতেই ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ইসরায়েলিরা ১,৪০৬টি সম্পত্তি কিনেছেন, যার মধ্যে ৪৮১টির দলিল সম্পন্ন হয়েছে। লিমাসোলে তারা কিনেছেন ১,১৫৪টি সম্পত্তি এবং ৫১১টির দলিল সম্পন্ন হয়েছে।
তুলনামূলকভাবে যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার নাগরিকরা সেখানে বেশি জমি কিনলেও, ইসরায়েলিদের ‘সংবেদনশীল এলাকায়’ জমি কেনা এবং বসতি গড়ে তোলার ধরন এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ায় ইইউ নাগরিকদের সাইপ্রাসে জমি কেনায় তেমন বাধা নেই। তবে বাইরের দেশের নাগরিকদের জমি কেনায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আকেল পার্টি দাবি করছে, ইসরায়েলিরা ‘গোল্ডেন ভিসা’ কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে ব্যাপক জমি কিনছেন এবং সেই আইনে কড়াকড়ি আনার জন্য সংসদে দুটি বিলও উত্থাপন করেছে দলটি।
সাইপ্রাস মেইলসহ একাধিক স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এবং ইসরায়েলের পত্রিকাতেও সম্প্রতি এই ‘জমি কেনার হিড়িক’ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন, যদি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনা হয়, তাহলে ইসরায়েল ধীরে ধীরে সাইপ্রাসে একটি ‘সেফ জোন’ বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত জায়নবাদী অঞ্চল তৈরি করে ফেলতে পারে, যা ভবিষ্যতে স্থানীয়দের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সংকট তৈরি করতে পারে।
স্তেফানোর ভাষায়, যদি লিমাসোল বা লারনাকায় যান, স্থানীয়রা নিজেরাই বলে দেবে কোন এলাকায় বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু সরকার এ নিয়ে নীরব।
এই হুঁশিয়ারি কোনো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নয়- বরং বাস্তব পরিসংখ্যান ও ঘটনাপ্রবাহের আলোকে জন্ম নেওয়া এক ভয়। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভেতর যদি আরেক গোষ্ঠীর আধিপত্যশীল আবাস গড়ে ওঠে, তাহলে ইতিহাস কি আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্ত করতে চলেছে?
মন্তব্য করুন