বাবাকে করেছেন গৃহবন্দি, ভাইদের করেছেন আটক। সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগ থেকে শুরু করে ইয়েমেনে ভয়াবহ হামলা করে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন তিনি। ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার আগেই রিভলবার ঠেকিয়ে জমি দখলের মতো অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
মাত্র ৯ বছর আগেও সৌদি আরবের রাজনীতিতে তার নাম তেমন কেউ শোনেননি। তার ক্ষমতা দখলের পথটা ছিল আরও নাটকীয়! তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ যখন ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত, তখন সিংহাসনের লড়াই জমে ওঠে। বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর সৌদি আরবের নতুন বাদশাহ হন সালমান বিন আবদুল আজিজ।
প্রথমে তিনি তার সৎভাই মুকরিনকে যুবরাজ হিসেবে নিয়োগ দেন, কিন্তু মাত্র তিন মাসের মধ্যেই বদলে যায় সব কিছু। মুকরিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়, আর নতুন যুবরাজ হন বাদশাহর ভাইপো মোহাম্মদ বিন নায়েফ। আর মোহাম্মদ বিন সালমান পান ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদ পাওয়ার পরই রাজপ্রাসাদে অদৃশ্য খেলা শুরু করলেন তিনি। এমবিএস নামে বহুল পরিচিতি পাওয়া সালমান তার বাবার দিকে নজর রাখা শুরু করেন। আস্তে আস্তে এমবিএস তার বাবাকে ঘনিষ্ঠজন ও পরিবার থেকে আলাদা করতে থাকলেন। এমনকি বাদশাহকে তার স্ত্রী অর্থাৎ মোহাম্মদ বিন সালমানের মা এর সঙ্গেও দেখা করতে বাধা দেওয়া হত। বাবার নিরাপত্তা ও নজরদারিতে নিজের প্রভাব বাড়াতে থাকেন তিনি। এমনকি তার মা এবং দুই বোনকে গৃহবন্দি করেন এবং বাবাকে এ সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেতে দেননি।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দ্রুতই নিজের প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন সালমান। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ তার তত্ত্বাবধানে ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির রাজধানী সানার ওপর বিমান হামলা চালানো হয়। প্রাথমিকভাবে প্রশংসিত হলেও পরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটিকে মহাপরিচালনার গাফিলতি হিসেবে দেখা হয়।
এরপর ২০ জুন ২০১৫, পবিত্র রমজান মাসের শেষের দিক। রাজপরিবারের সদস্যেরা মক্কায় জড়ো। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে দেখা করতে ডাকা হলো বাদশাহ সালমানের কক্ষে। লিফটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহরক্ষীদের অস্ত্র ও ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাকে গৃহবন্দি করা হয়। ইনি ডায়াবেটিকসে ভুগছিলেন, সেই রাতে তাকে ওষুধ না দিয়ে চাপের মুখে ফেলে পরের সকালে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। তিনি সালমানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
তাদের এই সাক্ষাতের ভিডিও সৌদি টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে সময় বারবার সম্প্রচার করা হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, বাদশাহ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন এবং নায়েফ তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছেন। এই নাটকীয় দৃশ্য সৌদি টিভি ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
নায়েফকে সরানোর পর এমবিএসকে যুবরাজ ঘোষণা করা হলো। তিনি যুবরাজ হওয়ার সাথে সাথেই ক্ষমতার সকল পদক্ষেপ নেন। বিনিয়োগ, অর্থনীতি, রাজনৈতিক প্রভাব—সবকিছু নিজের হাতে। ৪৪০ ফুট লম্বা বিলাসবহুল ইয়ট, দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম, পাঁচ তারকা রিটজ-কার্লটনে প্রিন্সদের গৃহবন্দি—সবকিছুই তার ক্ষমতার প্রতীক।
২০১৮ সালে নারীদের ‘আবায়া’ পরার বাধ্যবাধকতা শিথিল এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স অনুমোদন দেন তিনি। কিন্তু লেখকরা মনে করেন, এটি অর্থনৈতিক কারণেই করা হয়েছিল, নারীদের স্বাধীনতার জন্য নয়। ক্রমেই রাজপরিবারের ঐতিহ্য, ‘শূরা’ পরামর্শপ্রথা অমান্য করে নিজেকে একমাত্র শাসক হিসেবে তুলে ধরেছেন ফয়সাল। নিজের সিদ্ধান্ত ও রাজনীতির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা সমালোচনা যে বিন সালমান বরদাস্ত করবেন না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি।
তবে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে জামাল খাসোগি খুন হওয়া ঘটনায় এমবিএসকে নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তদন্ত শেষে সিআইএ জানায়, এই হত্যার নির্দেশ স্বয়ং যুবরাজই দিয়েছিলেন। বলা হয়, সৌদি আরবে অন্তত ১০ হাজার প্রিন্স রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। তাদের সবাইকে সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই এ ভাতার হার কমিয়ে দেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ী ও জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে ৩৮০ জনকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন তিনি। আজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের ক্ষমতার একক প্রতীক। বিশ্লেষকদের কেউ তাকে দূরদর্শী সংস্কারক বলছেন, আবার কেউ বলছেন স্বৈরশাসক।
মন্তব্য করুন