দেশের জ্বালানি খাতের জন্য নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই পরিকল্পনায় জ্বালানি খাতে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি, সরবরাহের উৎস বহুমুখীকরণ এবং আমদানিনির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার একটি সমন্বিত স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা করেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছি। আমাদের স্বল্পমেয়াদে লক্ষ্য হচ্ছে ওয়ার্কওভার কূপ, মধ্যম মেয়াদে ভোলার গ্যাস ব্যবহার এবং দীর্ঘমেয়াদে অনশোর ও অফশোর অনুসন্ধান।’
নতুন এই পরিকল্পনায় স্বল্পমেয়াদি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও উৎপাদন বাড়ানোয়। এই মেয়াদে সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে স্থলভাগে ৩১টি নতুন কূপ এবং তিনটি ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি, সিস্টেম লস কমানো এবং সম্ভাব্য গ্যাস অনুসন্ধান এলাকায় ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাপেক্সের জন্য একটি ২০০০ এইচপি (হর্সপাওয়ার) এবং একটি ১০০০ এইচপি ড্রিলিং রিগ সংগ্রহ করা হবে। যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদীর বালুতে বিদ্যমান মূল্যবান খনিজের বিস্তারিত অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হবে। দিঘীপাড়া কয়লাক্ষেত্র থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। জামালগঞ্জ কয়লা খনি উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন করা হবে এবং নতুন পাথর ও সিলিকা বালুর কোয়ারির তালিকা প্রণয়ন করা হবে।
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় আরও বলা হয়েছে, জরুরি চাহিদা মেটাতে সরকার বিদ্যমান সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করবে। একই সঙ্গে পিপিআর ২০০৮ ও পিপিএ ২০০৬ অনুসারে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির জন্য সরবরাহকারীদের তালিকাভুক্ত করা হবে এবং একটি নতুন ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) আধুনিকায়ন করা হবে।
দক্ষ জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণ স্বয়ংক্রিয় করা, বিতরণ পয়েন্টগুলোতে স্ক্যাডা স্থাপন, বিপিসির তেল সরবরাহ পয়েন্টে স্মার্ট ডিপো ম্যানেজমেন্ট, স্ক্যাডা এবং জিআইস বাস্তবায়ন করা হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে তেল সরবরাহ পয়েন্টে আরএফআইডি এবং ইআরপি চালু করা হবে।
অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ হিসেবে ভোলা থেকে বরিশাল ও খুলনা পর্যন্ত এবং বরিশাল-জাজিরা-লাঙ্গলবান্ধ-আমিনবাজার পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। জ্বালানি সংরক্ষণে বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদনসহ বিকল্প উৎসকে উৎসাহিত করা হবে। আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রিপেইড মিটার এবং শিল্প খাতে স্ক্যাডা সিস্টেম স্থাপন করা হবে।
মধ্যমমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০টি নতুন এবং ওয়ার্কওভার কূপ খনন করা হবে। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির দক্ষিণাংশ উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাতারবাড়ী, ভোলা—এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এনার্জি হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। মহেশখালীতে ট্যাঙ্ক ফার্ম স্থাপন এবং এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মাতারবাড়ীতে প্রস্তাবিত ভূমিভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল থেকে আরএলএনজি সরবরাহের লক্ষ্যে মহেশখালী থেকে বাখরাবাদ পর্যন্ত একটি গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে, যাতে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।
টেকসই এবং স্থিতিশীল পেট্রোলিয়াম তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে ইআরএল-২ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে, যা বার্ষিক ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াজাত করতে পারবে এবং ইউরো ৫-৬ মানের পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করবে। দক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির প্রধান স্থাপনাগুলো (পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম) স্বয়ংক্রিয় করা হবে। জ্বালানি ডিলারশিপ লাইসেন্সের জন্য ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করার কথাও বলা হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে নতুন গ্যাসচালিত কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং স্থল ও সমুদ্র উভয় এলাকায় সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৩০-৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সৌর, বায়ু, জৈবশক্তি ও পরীক্ষামূলক হাইড্রোজেন শক্তি অন্তর্ভুক্ত। উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) অধীনে অফশোর ও অনশোর এলাকায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন এবং মধ্যপাড়া পাথর খনি উন্নয়নের (দ্বিতীয় পর্যায়) কথাও এই পরিকল্পনায় রয়েছে।
এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) এলএনজি আমদানির চুক্তি, কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রায়-শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য, শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবুজ হাইড্রোজেনের সম্ভাব্য ব্যবহার, ইআরএল ইউনিট-৩ স্থাপন, মোংলা থেকে দৌলতপুর ও পার্বতীপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন নির্মাণ, কুয়াকাটা-পায়রা-বরিশাল গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ এবং একটি গ্যাস প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট ও গ্যাস সংগ্রহ পাইপলাইন বাস্তবায়নের কথাও এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন