গাড়ির পরে দেশে সবচেয়ে ব্যয়বহুল আমদানি পণ্য হচ্ছে লিফট, এলিভেটর ও এস্কেলেটর। দেশীয় উৎপাদনের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বিদেশ থেকে আমদানিবাবদ দেশকে ব্যয় করতে হয় ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি সময়ে এমনিতেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মধ্যে রয়েছে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে দেশে উৎপাদিত হয় এমন পণ্যের আমদানি কমানোর কোনো বিকল্প নেই। সেই বিবেচনায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে লিফট, এস্কেলেটর আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবকে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা দেওয়ার এক যুগান্তকারী প্রতিরক্ষণমূলক পদক্ষেপ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, সময়োপযোগী এই নীতি সহায়তায় দেশে লিফটের মতো উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন উৎপাদনমুখী ভারী শিল্প খাত বিকশিত হবে। বাড়বে এ খাতের বিনিয়োগ। এতে বিপুল কর্মসংস্থানের এক নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ত্বরান্বিত হবে। আমদানি ব্যয় হ্রাসের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপও অনেকাংশে কমে আসবে। এই খাতে বাড়বে দেশীয় শিল্পোদ্যাক্তাদের বিনিয়োগ।
উল্লেখ্য, গত ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশ থেকে লিফট, এলিভেটর, এস্কেলেটর আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেন। পাশাপাশি, আমদানি বিকল্প লিফট উৎপাদনে দেশীয় শিল্পে কর ও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখার ঘোষণা দেন। বাজেটে শিল্পোন্নয়নবান্ধব নীতি সহায়তা প্রস্তাব করায় অর্থমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশীয় উৎপাদকরা।
এ বিষয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রপ্তানি এবং দেশীয় বাজারনির্ভর শিল্পের ক্ষেত্রে নানা রকম সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্ভাবনার দৃষ্টিতে যা শিল্পবান্ধব এবং কর্মসংস্থানবান্ধব বাজেট। তিনি আরও জানান, দেশের ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বরাবরই ভালো করছে। এবার বাজেটে গৃহীত খাতসম্পর্কিত বিভিন্ন পদক্ষেপ আগামীতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য সুফল বয়ে আনবে। আর দেশে বিনিয়োগ আকৃষ্টে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি বিকল্প লিফট উৎপাদনকারী দেশীয় শিল্প বিকাশে প্রদেয় নীতি সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারণ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সামনে রেখে দেশের ইলেকট্রনিক্স, মেগাট্রনিক্স, অটোমোবাইলসহ ভারী ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নীতি সহায়তা দেওয়া খুবই ভালো উদ্যোগ। এতে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনার সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপক হারে। সেইসঙ্গে লিফট, এস্কেলেটরের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। লিফট এখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। দেশে এ খাতে বার্ষিক এক হাজার কোটি টাকার বেশি বাজার রয়েছে। কয়েক বছর আগেও এই বিশাল বাজারের পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। তবে শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন ২০১৮ সালে দেশে বাণিজ্যিকভাবে লিফট উৎপাদন শুরুর পর আমদানিনির্ভরতা হ্রাস পাচ্ছে। এখন কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানও লিফট উৎপাদন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই খাতের অভ্যন্তরীণ বাজারে বর্তমানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মার্কেট শেয়ার ২৫ শতাংশেরও বেশি। সরকারের নীতি সহায়তায় উচ্চ গুণগতমানের লিফট তৈরি ও বাজারজাতের মাধ্যমে অতি দ্রুতই সিংহভাগ মার্কেট শেয়ার অর্জন করে নিতে সক্ষম হবে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হবে, সরকারের এই উদ্যোগের ফলে দেশের মেধাসম্পদ দেশেই থাকবে। কারণ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশের পরিবর্তে দেশেই বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
মন্তব্য করুন