মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অন্যতম স্তম্ভ রপ্তানি আয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাবে প্রবৃদ্ধি ঘটলেও লক্ষ্যমাত্রার আয় পেতে ব্যর্থ হয়েছে সার্বিক পণ্য রপ্তানি খাত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, ডলার সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সংকটের মধ্যেও এ সময় পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরজুড়ে রপ্তানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বছর শেষে আয় তার থেকে ৪ দশমিক ২১ শতাংশ কম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে পণ্য রপ্তানি খাত। বার্ষিক রপ্তানি আয়ের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল সোমবার (জুলাই-জুন) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এতে দেখা যায়, সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। সেই হিসাবে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার আয়ে ঘাটতি হয় বা কম পাওয়া গেছে ৪ দশমিক ২১ শতাংশ।
এর আগে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে প্রবাসী আয়েও ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা ৫৮ কোটি ডলার বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
মূলত তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি আয় ভালো হওয়ায় সামগ্রিক রপ্তানি বেড়েছে। তবে পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্রকৌশল পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বৈশ্বিক মন্দার কারণে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই পণ্য রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা বজায় ছিল। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। পরের দুই মাস সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে যায়।
তবে নভেম্বরে রপ্তানি আয় উঠে যায় ৫০০ কোটি ডলারের ওপরে। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে তা আবার কিছুটা কমে যায়। মার্চ এবং এপ্রিল মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও মে মাসে তা কিছুটা বেড়ে যায়। সবশেষে অর্থবছরের শেষ মাস জুনে তা আবার ৫০০ কোটি ডলারের উপরে চলে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার-সংকটের এ সময়ে গত মার্চ থেকেই পণ্য রপ্তানি নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। ওই মাসে হঠাৎ করেই রপ্তানি আয় কমে যায়। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বৃদ্ধিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আগামীতে প্রবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকবে কি না, সেই বিষয়ে রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সালাম মুর্শেদী কালবেলাকে বলেন, চলমান বৈশ্বিক সংকটে তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা এখন পর্যন্ত বায়ারদের কাছ থেকে খুব বেশি অর্ডার আসছে না। মে মাসে বেশি রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঈদের ছুটির আগে ওভারটাইমের মাধ্যমে কাজ করিয়ে আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই পণ্য পৌঁছে দিয়েছি। যে কারণে অর্থবছরের শেষ সময়ে রপ্তানি আয় কিছুটা বেড়েছে। তবে এটা আগামী দিনে অব্যাহত থাকবে কি না, সেই বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে সাধারণ সময়ে রপ্তানি আয় কম হয়। এটা এবার আরও বেশি কমবে বলে মনে হচ্ছে। কেননা এখন পর্যন্ত খুব বেশি অর্ডার আসেনি। যা খুবই আশঙ্কাজনক। তাই এ বিষয়ে সরকারের নীতি সহায়তা বাড়ানো দরকার।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ৫০৩ কোটি ১৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৪৯০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এর আগে মে মাসে ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। যদিও মার্চে রপ্তানি আয় কমেছে ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর আগের মাস এপ্রিলেও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে রপ্তানি আয়। ওই মাসে কমেছে সাড়ে ১৬ শতাংশ।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাকের মধ্যে নিট পোশাকে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ওভেন পোশাকে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মন্দার কারণে বিশ্ববাজারে কম দামের পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। এই বাড়তি চাহিদার সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি খাত হচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এ খাতে রপ্তানি হয়েছে ১২২ কোটি ডলারের পণ্য। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১০৯ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া বিদায়ী অর্থবছরে প্লাস্টিক পণ্যে ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
অন্যদিকে হিমায়িত মাছ, কৃষিপণ্য, রাসায়নিক পণ্য, রাবার, হস্তশিল্পের পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, কার্পেট, স্পেশালাইজড টেক্সটাইল ও হোম টেক্সটাইল, গ্লাস অ্যান্ড গ্লাস ওয়্যার, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
আলোচ্য সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৯১ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ কম। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ১১২ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। কৃষিপণ্য রপ্তানিও ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ কমেছে, এ খাত থেকে রপ্তানি হয়েছে ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের ১১৬ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।
হোম টেক্সটাইল খাতে রপ্তানি হয়েছে ১০৯ কোটি ৫২ লাখ ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ডলার। এই তিনটি খাতের রপ্তানি আয় বছরের শেষে এক বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করতে পারে বলে বিভিন্ন সময় প্রাক্কলন দেখিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু বিদায়ী অর্থবছরে তার চেয়েও অনেক কম রপ্তানি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্যসহ বেশ কয়েকটি রপ্তানি খাতের ব্যবসায়িক সংগঠন উৎসে কর ১ শতাংশের পরিবর্তে দশমিক ৫০ শতাংশ করার দাবি করে। যদিও রপ্তানিকারকদের অধিকাংশ দাবিই বাজেটে বাস্তবায়িত হয়নি।
বাজেটে রপ্তানি খাত মোটাদাগে কিছু না পেলেও চলতি মাস থেকেই রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পাচ্ছেন ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা, আগে যা ছিল ১০৭ টাকা। তাতে আগের চেয়ে বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে ৫০ পয়সা বেশি পাচ্ছেন।
মন্তব্য করুন