প্রায় তিন বছর আগে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর সারোয়ার হাসান আলো। তা সত্ত্বেও অবৈধ আয়ের পুরোনো পথ থেকে সরেননি তিনি। প্রভাবশালীদের লাঠিয়াল হিসেবে মন্দির কিংবা ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, রাস্তার জায়গায় দোকান বসানো, নানা উৎস থেকে চাঁদা আদায়ের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেদার চালিয়ে যাচ্ছেন। জনপ্রতিনিধি হলেও এই কাউন্সিলর মূলত দখলদার, লুটেরা ও চাঁদাবাজদের মূলহোতা ও প্রশ্রয়দাতা বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
জানা গেছে, পর পর দুবার ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর হয়েছেন সারোয়ার হাসান আলো। শুরু থেকেই বড় বড় কোম্পানির হয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের জমি, বাড়ি কিংবা সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ট্রাস্টের জায়গা দখলে সিদ্ধহস্ত তিনি। পুরান ঢাকার বেশ কিছু মন্দির ও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি দখলের নেপথ্যে কাউন্সিলর আলোর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই ওয়ার্ডের রাস্তা-ঘাটসহ নাগরিক সেবার তেমন উন্নতি না হলেও কাউন্সিলরের ব্যক্তিগত সম্পদ ফুলেফেঁপে উঠেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মায়ের উত্তরাধিকার সূত্রে ওয়ারীর ১ নম্বর নবাব স্ট্রিটে প্রায় ৯২ শতাংশ জায়গার মালিক আলতাফুল হুদা ও আশরাফুল হুদা নামের দুই ব্যক্তি; কিন্তু তাদের পারিবারিক এই সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের কয়েকদিন আগে কাউন্সিলরের লোকজন বাড়িটি দখল করতে আসে। তারা বাড়ির ভেতরে থাকা বেশ কিছু জিনিসপত্র লুট করে করে নিয়ে যায়। কাউন্সিলরের লোকজন জায়গাটি আল মুসলিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করার জন্য চাপ দিচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
তারা জানান, জায়গাটির বাজারমূল্য প্রায় ১৮০ কোটি টাকা; কিন্তু কাউন্সিলর তার লোকজনের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে এই জায়গা দখলের চেষ্টা করছেন। এই দখল প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে।
একজন ভুক্তভোগীর ভাষ্য, ‘একদিকে হামলা আতঙ্ক, অন্যদিকে ভুয়া মামলা দিয়ে পরিবারের সবাইকে হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের সম্পত্তি ও জীবন রক্ষার দাবি করছি।’
জানা যায়, কাউন্সিলর আলোর বিরুদ্ধে প্রভাবশালীদের হয়ে নিরীহ মানুষের জায়গা-জমি দখলের অভিযোগ নতুন নয়। তিনি নিয়মিতই একজনের জায়গা আরেকজনকে দখল করে দেওয়ার কন্ট্রাক্ট নেন। তার দখলদারিত্বের অন্যতম টার্গেট পুরান ঢাকার বিভিন্ন মন্দির ও দেবোত্তর সম্পদ। পুরান ঢাকার ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডের ৩৮ নম্বর বাড়ির দোতলা ভবনে এক সময় শঙ্খনিধি জিউ বিগ্রহ মন্দির ছিল। তবে বর্তমানে সেখানে মন্দিরের কোনো অস্তিত্ব নেই। একটি বাণিজ্য সংগঠনের সাইনবোর্ড টানিয়ে ভবনটি দখল করে গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ ও অফিস গড়ে তোলা হয়েছে। সেইসঙ্গে ১০ থেকে ১২টি দোকান বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কাউন্সিলর আলো একসময় ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমান কমিটিতে সহসভাপতি পদে থাকলেও তিনিই এ সংগঠনের হর্তাকর্তা বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ মঠ-মন্দির মিশনের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার ঘোষ কালবেলাকে বলেন, ‘টিপু সুলতান রোডের ওই বাড়িতে মন্দির ছিল। কয়েক বছর আগে একটি শিল্প মালিক সমিতির নামে মন্দিরের জায়গা দখল করেন কাউন্সিলর আলো। সেখানে তিনি একাই সব। তার কথা ছাড়া কিছু হয় না।’
অন্যদিকে শ্রীশ্রী কালাচাঁদ ঠাকুর জিউ ট্রাস্টের শত কোটি টাকার সম্পদ দখল করে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছেন দুই কাউন্সিলর ও তাদের লোকজন। এই ভবনে থাকা বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত ‘বেগম’ পত্রিকার অফিসও উচ্ছেদ করেছে দখলদাররা।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে সারোয়ার হাসান আলোর নেতৃত্বে শ্রীশ্রী বিগ্রহ রাধাকান্ত জিউ ঠাকুর, শ্রীশ্রী লক্ষ্মী ঠাকুরানী, শ্রীশ্রী জনদিন চক্র জিউ ঠাকুর মন্দিরসহ কয়েকটি ধর্মীয় স্থাপনা দখলের চেষ্টা করা হয়। তবে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ও ইসকনের একজন নেতৃস্থানীয় একজন সাধুর চেষ্টায় মন্দিরগুলো রক্ষা পায়।
শ্রীশ্রী বিগ্রহ রাধাকান্ত জিউ ঠাকুর মন্দিরের সেবক রূপায়ণ গৌর দাস বলেন, ওয়ারীর ভূতের গলি এলাকায় এই মন্দিরটি একসময় দখল করা হয়েছিল। দখলদারদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অনেকেই ছিলেন। তবে আমরা তা প্রতিরোধ করেছি এবং মন্দির উদ্ধার করেছি।
চন্দ্র মোহন লেনের রাধা-গোবিন্দ জিউ বিগ্রহ মন্দিরের সেবক গোবিন্দ পরম সুধা দাস বলেন, ‘পুরান ঢাকার অধিকাংশ দেবোত্তর সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে। অনেক মন্দির আছে যার সামনে-পেছনে অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে। আমরা সেসব মন্দিরের জায়গা উদ্ধারে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা চাই; কিন্তু উল্টো তারা যখন নানা অজুহাতে জায়গাগুলো দখল করেন, তখন আমাদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না।’
সম্পত্তি দখল ছাড়াও ওয়ারী থানার বিভিন্ন অলিগলিতে সিটি করপোরেশনের জায়গার পজিশন বিক্রি করে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো, ধোলাইখালে সিটি করপোরেশনের রাস্তা দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, কাউন্সিলরের দখল ও চাঁদাবাজিতে জোলপুর ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসফাক হোসেন আজীম, জয়কালী মন্দির ইউনিট আওয়ামী লীগ সভাপতি ইকবাল হোসেন, ফরহাদ হোসেনসহ অনেকেই সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হাসান আলো বলেন, ‘এসব অভিযোগ ঠিক নয়। শঙ্খনিধি মন্দির আমি কেন দখল করব? ৩৮ টিপু সুলতান রোডের দ্বিতল ভবনটি আমি দখল করিনি। সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির অফিস। আমার জানা মতে, ওটা সরকারি সম্পত্তি। কোনো মন্দিরের সম্পত্তি কি না, তা আমার জানা নেই।’
সিটি করপোরেশনের রাস্তার পজিশন বিক্রির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ফুটপাতে দোকান বসাইনি। পজিশন বিক্রি তো দূরের কথা—আমি কোনো দোকান থেকে চাঁদা উঠাই না। বরং থানা প্রশাসনের মাধ্যমে এসব হচ্ছে। আমরা সিটি করপোরেশন থেকে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।’
সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উত্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই কাউন্সিলর।
সিটি করপোরেশনের রাস্তার ফুটপাতের দোকান থেকে পুলিশের চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানে আলম বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ সত্য নয়। ওয়ারী থানার কোনো প্রধান রাস্তার ফুটপাত দখল হয়নি। আর অলিগলিতে ফুটপাতে দোকান বসিয়ে কারা চাঁদাবাজি করছে, আপনারা অনুসন্ধান করে দেখেন।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিকদের অনেক সুপারিশ আসে। তবে আইনের ভেতরে থেকে তার সব করা সম্ভব হয় না। এতে আমাদের প্রতি অনেকে মন খারাপ করতে পারেন।’