তরুণ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়ন ও কাজের সুযোগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হলেও নতুন বাজেটে নেই কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। সরকারি ও বেসরকারি খাতে উচ্চ হারে বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অর্জন করা কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সবার জন্য শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এবং জনশক্তিকে দক্ষ ও শ্রমবাজারের উপযোগী করে তোলা আমাদের অন্যতম অর্থনৈতিক নীতি কৌশল। ফলে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে ২০ লাখের বেশি মানুষ যুক্ত হলেও আমাদের প্রচেষ্টায় দেশে বেকারত্বের হার হ্রাস পাচ্ছে। তবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবসহ পরিবর্তিত জাতীয় ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় কর্মসংস্থান কাঠামো এবং দক্ষতা চাহিদার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমরা টেকসই কর্মসংস্থানের উপযোগী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি।’
তবে টেকসই কর্মসংস্থানের জন্য আগামী অর্থবছরে কী ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে—বাজেটে তা স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে শোভন ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান বাড়াতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।
অবশ্য বাজেট বক্তৃতায় কর্মসংস্থানের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খাতের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ২০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের অদূরে ১ হাজার ১৫০ একর জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরীতে ৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ২০৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, চলমান ও ভবিষ্যতের শিল্প-বাণিজ্যের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে শ্রমিকের দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে সরকারের স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (এসইআইপি) মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের কর্মক্ষম শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে আগামী
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৪৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ২২৩ কোটি ৪০ লাখ এবং উন্নয়ন ব্যয় ১২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৫৭ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে ৪৭০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে এ বরাদ্দ কোন খাতে এবং তা শ্রমশক্তিকে কাজে লাগাতে কীভাবে ভূমিকা রাখবে, তা স্পষ্ট নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে শ্রমশক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে অনেক সময় সরকারিভাবে সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের কিছু কর্মসূচি চালু থাকলেও তার পরিসর অনেক কম। কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের আয়মূলক কাজের সুযোগ কমে গেছে। এ অবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক সরকারি কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা দরকার। তবে বাজেটে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কার্যক্রমে উপকারভোগীদের ভাতার হার ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ দ্বিগুণ করা হলেও তা কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরির চেয়ে অনেক কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক ফলাফলের হিসাবে দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৩ লাখ। এর মধ্যে শিক্ষা গ্রহণে নিয়োজিত তরুণ এবং বয়স্ক নাগরিক মিলিয়ে ৪ কোটি ৬৯ লাখকে শ্রমশক্তি বিবেচনা করা হয় না। বাকি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার মানুষ কোনো না কোনো কাজের উপযুক্ত। এর মধ্যে নানা ধরনের কাজে নিয়োজিত আছেন ৭ কোটি 8 লাখ। বাকি ২৬ লাখ ৮০ হাজার সম্পূর্ণ বেকার।
অবশ্য ২০১৯ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) প্রকাশিত ‘কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতা এবং খাতভিত্তিক বিনিয়োগ সমীক্ষা’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাগজে-কলমে বেকার না হলেও দেশে ১ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ তাদের যোগ্যতা কিংবা চাহিদা অনুযায়ী কাজ ও মজুরি পান না।
উন্নয়নশীল দেশের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি থেকে শ্রমিকরা শিল্প খাতে যাবে। কিন্তু ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এর বিপরীত প্রবণতা বিরাজ করছে। ২০১৬-২৭ সালের জরিপের তুলনায় সর্বশেষ হিসাবে দেশে মোট কর্মসংস্থানে কৃষির অংশ বেড়েছে এবং শিল্পের অংশ কমেছে। আর এই প্রবণতার অর্থ হলো শিল্প ও সেবা খাতে কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হলে উৎপাদনমুখী শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য নতুন গন্তব্য অন্বেষণ, দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখাসহ কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শ্রমবাজারের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে এসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালবেলাকে বলেন, ‘কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়টি এবারের বাজেটে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বেকারদের জন্য বিশেষ করে গ্র্যাজুয়েটদের জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেই। অর্থমন্ত্রী কেবল পুরোনো উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতার কথা বলেছেন। এগুলো মোটেও যথেষ্ট নয়। দ্রুত কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ ছিল সরকারের, কিন্তু তা হয়নি।’
দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে বেসরকারি খাত। মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৮ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এক দশকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে তা এক রকম স্থবির হয়ে আছে। গত চার অর্থবছরে ধরে এ হার জিডিপির ২৩ থেকে ২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাজেটে আগামী অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধির আশা করা হয়েছে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের জিডিপির ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ বিনিয়োগ এক বছরের মধ্যে কীভাবে প্রায় ৪ শতাংশ বাড়াবেন—সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা ঘোষণা করেননি। বরং বাজেটে আয়-ব্যয়ের ব্যবধান বা ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাাঁড়াতে পারে। এবারের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাত থেকে এ বিপুল পরিমাণ টাকা সরকারের কাছে চলে গেলে বেসরকারি খাত চাহিদামতো ঋণ পাবে না। এর ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দেশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা বড় কারণ হলো গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ অবকাঠামোগত সমস্যা, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, সুশাসনের সংকট এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। এসব সমস্যা সমাধানে গত এক দশকে সরকার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। সংকট কাটিয়ে একটি ইতিবাচক সম্ভাবনা তৈরি হলেও কভিড ও যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তা আবারও বড় ধাক্কা খেয়েছে। বিশেষ করে ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়ায় বিদ্যুৎ সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশ্ব অর্থনীতির চলমান মন্দার সঙ্গে সম্পর্কিত এসব সমস্যা সমাধানের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রী দিতে পারেননি।
আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারকে গতিশীল করা, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধানসহ বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার ওপর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নির্ভর করছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
অন্যদিকে বরাবরের মতো এবারো বাজেটে সরকারি বিনিয়োগের বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরই বাজেটে বিশাল আকারের এডিপি ঘোষণা করা হলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। তারপরও বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা শুরুর পর কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগ বন্ধ রাখার নীতি ঘোষণা করেছে সরকার। নতুন অর্থবছরের একটি বড় অংশ জুড়েই এই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকতে পারে। ফলে আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে সরকারের বিনিয়োগের লক্ষ্য পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থান খাতবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ড. রিজওয়ানুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এবারের বাজেটে কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে অনেক বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। এমনিতেই আমাদের দেশে প্রবৃদ্ধি থেকে যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বাজেট বা অন্য নীতিমালায় শোভন কাজ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বিশেষ কোনো নজর দেওয়া হচ্ছে না। তার ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষকে কোনো একটা কিছু করে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করতে হচ্ছে। আর তাদের একটা বড় অংশ দরিদ্র অথবা দারিদ্র্য সীমার কাছাকাছি থেকে যাচ্ছে ।’
মন্তব্য করুন