শোকাবহ আগস্ট মাসে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সাধারণত শিথিল রাখা হয়। কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে গত কয়েক সপ্তাহে ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক দিক তেমন ভালো যায়নি। তাই আগস্টের শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে ঘুরে দাঁড়াতে চায় আওয়ামী লীগ। শোকের কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও জোর দিতে চায় দলটি।
জানা গেছে, শোকের মাসে দলীয় কর্মসূচির পাশাপাশি দল ও সহযোগী সংগঠনের কোথায় কোথায় দুর্বলতা, সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতা চিহ্নিত করার কাজও চলমান রাখবে দলটি। তৃণমূল পর্যন্ত চাঙ্গা করতে শোক পালনের কর্মসূচি বিভাগ, জেলা, থানা এমনকি ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। প্রতি বছরের মতো এই আগস্টে কর্মসূচি শুধু আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল, স্বেচ্ছায় রক্তদান, চিত্র প্রদর্শনীর অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না রেখে ওয়ার্ড ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যুব সমাবেশ, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, বিভাগীয় কমিশনার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক কালবেলাকে বলেন, তৃণমূলই আওয়ামী লীগের সম্পদ। বড় এই রাজনৈতিক দলে কিছু ভুলভ্রান্তি থাকেই। খুব শিগগির আবার ঘুরে দাঁড়াবে দল। শোকের মাসে সারা দেশে যে বিস্তৃত কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তা পালন করে সহযোগী, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হবে অচিরেই।
এদিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মাসজুড়ে শোক পালনে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এতে প্রতিটি সহযোগী সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠনগুলো আলাদা আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করবে। কেন্দ্রীয় সূচির বাইরেও মাসজুড়ে আলাদা আলাদা করে সংগঠনগুলো কর্মসূচি পালন করবে। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সব সহযোগী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে কর্মসূচি পালনে আহ্বান জানানো হয়েছে। দলের সব জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডসহ সব শাখার নেতাদের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সংগতি রেখে কর্মসূচি পালন
করতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ঘেঁটে দেখা যায়, কৃষক লীগ আগস্টের প্রথম দিনে আলোচনা সভার মাধ্যমে শোকের কর্মসূচি শুরু করে। আজ (শুক্রবার) সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতের উদ্দেশে সারা দেশের মসজিদে মসজিদে দোয়া ও মোনাজাতের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল (শনিবার) অনুষ্ঠিত হবে শোক মিছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হবে কৃষক লীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগের আলোচনা সভা। সব জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, আলোচনা সভা, দুস্থদের মাঝে খাদ্য বিতরণ, বৃক্ষরোপণ করবে কৃষক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যরা।
৪ আগস্ট সারা দেশে যুবলীগ যুব সমাবেশ/মানববন্ধন/অবস্থান কর্মসূচি ও বিভাগীর কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করবে। ৭ আগস্ট দেশের সব উপজেলা, থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়নে যুব সমাবেশ/মানববন্ধন/অবস্থান কর্মসূচি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি পেশ করবে।
জানা গেছে, সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও স্বীকার করেছেন বিভিন্ন বৈঠকে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নানা দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে বলে স্বীকার করেন তিনি। আন্দোলনের সময় এমপিরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, কাউন্সিলরদের মধ্য সমন্বয় ছিল না বলেও সমালোচনা করেন তিনি। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মোহাম্মদপুরে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেসব এলাকায় দলের দুর্বলতার কথাও বলেন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড ও থানা কমিটি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দোষারোপও করেন। মোহাম্মদপুরে ব্যর্থতার দায়ে ২৭টি ইউনিট কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।
সমন্বয়হীনতা এতই তীব্র যে, কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি হাতাহাতিতে জড়ান। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আয়োজিত ঢাকা-৮-এর নেতাকর্মীদের বৈঠকেও হট্টগোল বাধে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৪ দলকে সক্রিয় করে ক্ষমতাসীনরা। বিরোধী দলে থাকার সময় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের রাজনীতিতে জড়িত ছাত্রনেতা ও নেত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেই সভায় দলের সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতেও হট্টগোল হয়। কেন্দ্রীয় এক নেতার বিরুদ্ধে দুয়ো ধ্বনি দেয়। এসব কারণে মহানগর আওয়ামী লীগও শোকের কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য দায়ীদের ভূমিকা নিয়ে কারণ অনুসন্ধান করবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় শোকের মাসে প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কর্মসূচি পালন করব। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদের ভুলত্রুটি শনাক্তও করবে।
এদিকে, প্রায় প্রতিদিনই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দলের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে করণীয় ঠিক করতে বৈঠক করছেন। জনবান্ধব কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে দলের ইমেজের যে ক্ষতি হয়েছে, তা দূর করতে নেওয়া হচ্ছে কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় নেতারা, আওয়ামী লীগের এমপি ও জনপ্রতিনিধিরা অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করে দলের সব পর্যায়ের সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে কাজ করছেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, শোকের মাসে দলের কর্মকাণ্ড অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি থাকে। এ সময় শোক পালন করলেও দলীয় নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে চাঙ্গা হয়। এবার তো কর্মসূচি আরও গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে।