ভরা মৌসুমেও পায়রা নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা নেই। জেলেদের দাবি, তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্যে (গরম পানি) নদীর দূষণ ঘটছে। এ ছাড়া সাগর মোহনায় ডুবোচরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ইলিশ উল্টোপথে ফিরে যায়। এ দুটি কারণে নদীতে ইলিশের বিচরণ কমেছে। একই মত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আনিছুর রহমানের।
উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনার আমতলী ও তালতলীতে ১৪ হাজার ৬৮৯ নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে আমতলীর ৬ হাজার ৭৮৯ এবং তালতলীর ৭ হাজার ৯০০। সারা বছর মাছ শিকার করেই চলে তাদের সংসার জীবন। নদীতে মাছ ধরা না পড়লে উনুনে পাতিল ওঠে না। এরই মধ্যে ইলিশ মৌসুমের এক মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই ভরা মৌসুমেও পায়রা নদীর জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না।
পায়রায় ইলিশ না মেলার কারণ হিসেবে স্থানীয় জেলে ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুড়িশ্বর বা পায়রা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার একটি নদী। নদীটি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাটি ইউনিয়ন এলাকার প্রবহমান পান্ডব নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। পরে এর জলধারা বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। নদীটির উজানের তুলনায় ভাটির দিক অধিক প্রশস্ত। অন্যদিকে বিষখালী ও বলেশ্বর নদী বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে।
তিন নদীর মোহনাকে জেলেদের ভাষায় ‘গাঙ্গের আইল’ বলা হয়। বঙ্গোপসাগরের মিলিত হওয়া বিষখালী-বলেশ্বর মোহনায় লালদিয়া সমুদ্রসৈকত এবং পায়রা-বিষখালীর মোহনায় পদ্মাবাবুগঞ্জ চর। তিন নদীর মোহনায় এ চর স্বাভাবিক জোয়ারের পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে নদীর গভীরতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। পায়রা-বিষখালী নদীর মোহনায় রয়েছে বড়াইয়্যার ডুবোচর।
১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার জুড়ে এ চর ফকির হাট থেকে শুরু করে আশার চরে মিলিত হয়েছে। এ চরটি বঙ্গোপসাগর থেকে পায়রা নদীতে জোয়ারের পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। আশার চরের শেষ সীমানা থেকে শুরু হয়েছে নলবুনিয়ার ডুবোচর। এ চরের বিস্তৃতি ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার। এ ডুবোচরটি পায়রা নদীর প্রবেশদ্বারে অবস্থিত। পায়রার প্রবেশমুখ অতিক্রম করে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার পর পদ্মা ও কুমিরমারা ডুবোচর।
এ চরের বিস্তৃতি ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার। এ চরে পড়ন্ত ভাটায় লোকজন হাঁটাচলা করে। জেলেরা খুঁটি গেড়ে জাল ফেলেন। জোয়ারের সময় এ ডুবোচরে প্রচণ্ড আফাল হয়। এ সময় ডুবোচরের কারণে সাগর থেকে জোয়ারের পানির সঙ্গে ইলিশ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে।
এ ছাড়া ২০১৯ সালে তালতলীর বঙ্গোপসাগর মোহনা সংলগ্ন জয়ালভাঙ্গা এলাকায় আইসোটেক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ২০২২ সালে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যায়। ওই সময় থেকে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য ও গরম পানি পায়রা নদীতে ফেলা হয়। এ কারণেও পায়রা নদীতে ইলিশের বিচরণ কমেছে।
পায়রা নদীতে ইলিশ শিকারি জেলে ছত্তার, লাল মিয়া ও জাহিদ মোল্লা জানান, জোয়ারের প্রথম ভাগে নদীতে তেমন স্রোত থাকে না। ফলে ইলিশ প্রবেশ করতে পারে না। জোয়ারের মধ্যভাগে নদীতে স্রোতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ওই স্রোতে আসা ইলিশ জালে ধরা দেয়। তাই পায়রা নদীতে তেমন ইলিশের দেখা মেলে না। তারা বলেন, নদীর মোহনায় সৃষ্ট ডুবোচরগুলো খনন করা না হলে পায়রা নদী থেকে ইলিশ একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
তালতলী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন কালবেলাকে বলেন, সাগর মোহনায় ডুবোচরের কারণে পায়রা নদীর নাব্য হারিয়েছে। এতে জোয়ারের স্রোতের তীব্রতা কমে যাওয়ায় ইলিশ প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই পায়রা নদীতে ইলিশ কম। পায়রা নদীর মোহনায় ডুবোচর খনন করে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে পারলে ইলিশ প্রবেশ এবং প্রজননে কোনো বাধা থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, সাগর থেকে প্রথম জোয়ারের সঙ্গে নদীতে ইলিশ প্রবেশ করে। ওই সময় ইলিশ ডুবোচরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উল্টো পথে সাগরে ফিরে যায়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক কালবেলাকে ড. মো. আনিছুর রহমান বলেন, সাগর মোহনা অঞ্চলে ডুবোচর তথা তীব্র নাব্য সংকটে ইলিশ চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইলিশ চলাচলে গভীর পানির প্রয়োজন; কিন্তু ডুবোচরের কারণে নদীতে সেই পরিমাণ গভীরতা না থাকায় সাগর মোহনা দিয়ে ইলিশ প্রবেশ করতে পারে না। ফলে নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, সাগর মোহনায় জয়ালভাঙ্গা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম পানি ও বর্জ্যও এর জন্য দায়ী।
মন্তব্য করুন