রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত ৬টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। তার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। তারা বলছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান অংশীদার হলো রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সংস্কারের পথে সরকারকে এগোতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার এখন পর্যন্ত দুই দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে গত ১১ সেপ্টেম্বর সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে ৬টি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে এই খাতের সংস্কার-কমিশনের প্রধান করার ঘোষণাও দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এসব সংস্কার কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাজ আজ ১ অক্টোবর থেকে শুরু করে এবং পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু আজ থেকে ছয়টি সংস্কার কমিশনের কাজ শুরু হচ্ছে না। তার আগে আরেক দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে উপদেষ্টা পরিষদ।
গত সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদান শেষে রোববার রাতে দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সফরের বিভিন্ন বিষয় জানাতে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর হেয়ার রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত ৬টি সংস্কার কমিশনের কাজ শুরু করার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরেক দফা বসবে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। ছয়টি কমিশন মঙ্গলবার (আজ) থেকে কাজ শুরু করার কথা; কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদ আলোচনা করতে চাচ্ছে। আলোচনা করে তারা চূড়ান্ত করবেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, ছয়জন কমিশনারের নাম যেহেতু ঘোষণা হয়ে গেছে আমি বলতে পারি টেকনিক্যালি কমিশনের কাজ কিছুটা হলেও শুরু হয়েছে। পলিটিক্যাল পার্টিরা তো এখানে একটি স্টেকহোল্ডার। তাদের সঙ্গে একটু আলাপ হবে এবং সেখানে তাদের মতামত চাওয়া হবে।
‘সাকসেসফুল ও ঐতিহাসিক সফর’: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। অধিবেশন ঘিরে নিউইয়র্কে তার চার দিনের সফরকে ‘খুবই সাকসেসফুল ও ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করেছেন তার প্রেস সচিব। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘গত ৩০-৪০ বছরে বাংলাদেশের লিডার, যারা জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়েছিলেন, সেখানে হয়তো দুই-তিনজন আঞ্চলিক নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন বা দুই-তিন জাতিসংঘ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। অধ্যাপক ইউনূস ২৪ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর এই চার দিন অসম্ভব প্যাকড একটা শিডিউল মেনটেইন করেছেন। ১৫টি মিটিং হয়েছে, এর মধ্যে ১২টি হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে।’
প্রধান উপদেষ্টা সফরে উষ্ণ সংবর্ধনায় সিক্ত হয়েছেন মন্তব্য করে শফিকুল আলম বলেন, ‘যেমন ধরেন জো বাইডেন, ইতালির প্রাইম মিনিস্টার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, ডাচ প্রাইম মিনিস্টার, চীনের ফরেন মিনিস্টার, ইউএসএর ফরেন সেক্রেটারি অব স্টেট, আইএমএফের চিফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চিফ, আইএলওর চিফ, জাতিসংঘের মহাসচিব। দেখা যাচ্ছে, উনি কোনো মিটিং থেকে বের হচ্ছেন, আর একজন ওয়ার্ল্ড লিডারের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে, হাগ করছেন, জড়িয়ে ধরছেন। সবমিলিয়ে তাকে একটা রকস্টার রিসেপশন দেওয়া হয়েছিল। এসবের মূল যে এসেন্স, তা হচ্ছে সবাই বলেছেন যে, এই সরকারকে তারা সাপোর্ট করতে চান এবং সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করতে ইচ্ছুক। এটা আমাদের বাংলাদেশের জন্য খুবই পজিটিভ একটা মাইলস্টোন ছিল।’
‘নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে মন্তব্য সেনাপ্রধানের ব্যক্তিগত মতামত’: বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যাশিত সময়সীমা নিয়ে যা বলেছেন, সেটা তার ব্যক্তিগত মতামত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা রাষ্ট্র মেরামতের একটা কাজ। কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে রাজনৈতিক কনসালটেশন এবং এরপর বাংলাদেশের জনগণ, সমাজ, অন্যসব স্টেকহোল্ডার যখন সেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে, তখন ইলেকশনের দিকে যাওয়া হবে। এটা কবে হবে? ১৬ মাস পর নাকি ১২ কিংবা ৮ মাস পরে—সেটা এখনই নির্ধারিত করা যাচ্ছে না। আর আমার মনে হয় যে, সেনাপ্রধান এখানে ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন।
যা বলছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা:
সংস্কারের আগে দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেছেন, যদিও আলোচনার বিষয়বস্তু কিছুই জানানো হয়নি। জানলে হয়তো বলতে পারব। তবে আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করার কথা। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্যই হওয়া উচিত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা বা দায়িত্ব হস্তান্তর করা। এসব বিষয় নিয়ে হয়তো তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। তারা যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, সেগুলোর কোনোটির মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের স্পষ্ট কোনো কথা নেই।
হাফিজ উদ্দিন বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন বিষয়ে হয়তো সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। এটাকে আমি ভালো উদ্যোগ হিসেবেই দেখি। সুতরাং আলোচনার পরই বলতে পারব সংস্কারের বিষয়ে তারা কতটুকু সিরিয়াস।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান গতকাল রাতে কালবেলাকে বলেন, কেন সরকার আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে চাইল, সে বিষয়ে আগে পরিষ্কার হতে হবে। তা ছাড়া কেনইবা তারা সংস্কার না করে বসার উদ্যোগ নিল, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা তো আগে থেকেই আহ্বান জানিয়েছি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই সংস্কার হওয়া উচিত। বিশেষ করে সংস্কারের বিষয় এবং সময় নিয়েই আলোচনার কথা বলেছি। যদি আবারও বৈঠক করে আমরা সেগুলো নিয়েই আলোচনা করব।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা ইতিবাচক। আমাদের ডাকলে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা ও নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে প্রস্তাব দেব।