নারায়ণগঞ্জে একটি কারখানায় চাকরি করতেন ২৮ বছর বয়সী আমেনা বেগম (ছদ্মনাম)। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার রয়েছে তার। অভাব-অনটন নিয়ে কথা বলেছিলেন এক সহকর্মীর সঙ্গে। তার নাম সেতু। অভাবের কথা শুনে দেশের বাইরে চলে যেতে আমেনাকে উদ্বুদ্ধ করেন সেতু। তাকে বলা হয়, দেশের বাইরে যাওয়ার পর তার আর অভাব থাকবে না। শাড়িতে নকশার কাজ করতে হবে, যে কাজের পারিশ্রমিক অনেক বেশি। উচ্চ বেতন আর সুন্দর জীবনের আশায় সেতুর কথায় রাজি হয়ে যান আমেনা। স্বামী ও পরিবারের সদস্যরা শুরুতে রাজি না হলেও আমেনা তাদের একপর্যায়ে রাজি করান।
সেতু ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে আমেনার পাসপোর্ট করান। ভিসা করিয়ে বৈধপথে ভারতে যান। বাস ও ট্রেনে করে আমেনাকে নেওয়া হয় মহারাষ্ট্রের সাংলি শহরে। পরে তাকে কৌশলে একটি যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেন সেতু। সেখানে কেড়ে নেওয়া হয় তার পাসপোর্ট ও মোবাইল। যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে নেমে আসে নির্যাতন। নির্মম নির্যাতনের একপর্যায়ে বাধ্য হন আমেনা।
২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর ভারতের মহারাষ্ট্র পুলিশের অভিযানে আমেনার মতো ৯ বাংলাদেশি নারী উদ্ধার হন। তাদের উদ্ধার করে মহারাষ্ট্রের সাংলি শহরের একটি সেফ হোমে রাখা হয়। ছয় মাস সেখানে রাখার পর তাদের দেওয়া হয় রেসকিউ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থার কাছে। এই রেসকিউ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের দুটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে। একটি হলো রাইটস যশোর, অন্যটি যশোর জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার। তারা এই ৯ নারীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং পরিচয়-ঠিকানা নিশ্চিত করে। পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই ৯ জনের প্রত্যাবর্তনের জন্য আবেদন করা হয়। দুদেশের সরকারের মধ্যে এই ৯ জনকে দেশে ফেরানো নিয়ে যোগাযোগ হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে ভারত সরকারের দেওয়া বিশেষ ট্র্যাভেল পারমিটের মাধ্যমে পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশ ৯ জনকে গ্রহণ করার পর তাদের রাইটস যশোর ও যশোর জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের তত্ত্বাবধানে দেয়।
রাইটস যশোর তাদের জিম্মায় পাঁচজন নারীকে গ্রহণ করে। কয়েকদিন কাউন্সেলিং ও চিকিৎসা দেওয়ার পর গত ৪ অক্টোবর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি চার নারীকে গ্রহণ করে যশোর জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার কর্তৃপক্ষ।
যশোরে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ করতেন নাজমা (ছদ্মনাম)। প্রতিবেশী সাইরা নামে এক নারী তাকে বিদেশে গিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন। নাজমাকে বোঝানো হয়, ভারতে গিয়ে রান্নার কাজ করলে ২০ থেকে ২৫ হাজার রুপি বেতন মিলবে। থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। পুরো বেতনের টাকাই দেশে পাঠানো যাবে। এভাবে নাজমাকে সচ্ছল জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে রাজি করান সাইরা। বাকি কাজটুকু করে সাইরার বোন পপি ও তার স্বামী। তারা নাজমার পাসপোর্ট তৈরি করে মেডিকেল ভিসায় ভারত নিয়ে যান। তাকেও একই কায়দায় মহারাষ্ট্রের একটি যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেন পপির স্বামী।
রাইটস যশোরের কর্মকর্তা সরোয়ার হোসেন বলেন, পাচারের শিকার এই নারী সবাই শ্রমজীবী। তারা খুলনা, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও ঢাকার বাসিন্দা। পোশাক কারখানা, টাইলস, স মিল এবং অন্যের বাসায় রান্নার কাজ করতেন তারা। বিক্ষিপ্তভাবে তারা যশোর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়েছেন। পাচারের শিকার নারীরা তাদের সহকর্মী, প্রতিবেশীদের মাধ্যমে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। সম্মানজনক কাজের আশ্বাসে নেওয়া হলেও তাদের জোর করে বানানো হয় সেক্স ওয়ার্কার। এই কর্মকর্তা জানান, তাদের মাধ্যমে ২০০৭ সাল থেকে দেড় হাজারের বেশি ভুক্তভোগীকে দেশে ফেরানো হয়েছে। যার মধ্যে ১৩শর বেশি নারী ও শিশু। তাদের মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার। যাদের বিভিন্ন যৌনপল্লি ও হোটেলে বিক্রি করা হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, এই পাচার হওয়া নারীদের ৯০ ভাগের বেশি নারীকে যৌনতায় বাধ্য করা হয়। বিদেশে নিয়ে যেসব সেক্স হাউস বা ব্রথেল আছে সেখানে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাদের কাউকে কাউকে রাষ্ট্র উদ্ধার করে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ করে উদ্ধার হয়। ভুক্তভোগী প্রান্তিক পর্যায়ের নাগরিক হওয়ার কারণে তিনি যে অন্যায়ের শিকার হয়েছেন, সে ঘটনার বিচারটুকু পান না বা বিচার চাওয়ার যে প্রক্রিয়া সে প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে চান না। কারণ তিনি যার বিরুদ্ধে মামলা করবেন তিনি হয়তো তার প্রতিবেশী বা একই এলাকার। ফলে সামাজিক বাস্তবতায় ভুক্তভোগী নারী বা তার পরিবার মামলায় যেতে চায় না। এ বাস্তবতা মানব পাচার বন্ধ না হওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করে। কারণ যারা এই পাচার বা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তারা খুব কম সংখ্যক আইনের আওতায় আসছে।
তিনি বলেন, এসব ঘটনা প্রতিরোধে প্রথম কাজ হচ্ছে—যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। ভুক্তভোগী ব্যক্তি যদি আগ্রহী না হন তবে রাষ্ট্র উদ্যোগ নিয়ে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করবে। আমাদের দেশে এসব ঘটনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা হলেও বিচার পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। যে কারণে এসব ঘটনা বিচারের মাধ্যমে সমাজে কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন হয় না।
তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তৌহিদুল হক। তার ভাষ্য, আমাদের এখানে সচেতনতা তৈরি করা বা মানুষকে গঠনমূলক কাজ করার যে প্রচেষ্টা, তা অনেক ক্ষেত্রে রাজধানী বা বিভাগীয় শহরে থাকে। কিন্তু সেটা তৃণমূল পর্যায়ে যায় না। এখন প্রয়োজন এই সচেতনতা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া, যাতে প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষ এতে সচেতন হতে পারে। আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে। দিবসকেন্দ্রিক এক দিনব্যাপী সচেতনতা করলে হবে না। একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর তা দেশব্যাপী করতে হবে। যেসব বিষয় মানুষকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত করছে, সেসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
সম্প্রতি দেশে ফিরে আসা ৯ নারীর বিষয়ে কোথাও কোনো মামলা হয়নি। তবে যশোরে একজন ভুক্তভোগীর পরিবার সাধারণ ডায়েরি করেছিল, যা বর্তমানে তদন্ত করছে যশোর জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তারাও ঘটনার তদন্তে বেশিদূর যেতে পারেনি। জড়িতদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করার পর্যায়েই রয়ে গেছে।
যশোর জেলা পিবিআইর পুলিশ সুপার রেশমা পারভীন বলেন, এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী কার মাধ্যমে, কীভাবে, কোন পথে গিয়েছেন, সেটা জানার চেষ্টা করি। ভুক্তভোগী যাদের মাধ্যমে যান, তাদের অধিকাংশের নাম-পরিচয় ঠিক থাকে না। তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। আবার যশোর সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এই পাচারকারীদের বড় একটা অংশ দেশের বাইরে আসা-যাওয়া করেন। কোনো ঘটনায় পুলিশ তৎপর হলে আসামিরা দেশ ছেড়ে ওই দেশে গিয়ে পাড়ি জমান। তবে তারা ফিরে এলে আমরা তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি।
অনেকে বেঁচে যান সীমান্তে: সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পার্শ্ববর্তী দেশে যাওয়ার সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের হাতে আটক হয়ে বেঁচে যান অনেক নারী। গ্রেপ্তার হয় পাচারকারীরাও। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত আট নারী ও একজন শিশুকে উদ্ধার করেছে বিজিবি। পাচারকারী গ্রেপ্তার হয়েছে চারজন। আর তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সাতটি।
গত ৮ অক্টোবর সিলেট গোয়াইনঘাটের রানীরঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের সময় এক কিশোরীসহ তিনজনকে আটক করে বিজিবি। এ সময় রুপম নামের মানবপাচার চক্রের এক সদস্য বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়।
গোয়াইনঘাট থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরদার তোয়ায়েল আহমেদ বলেন, আটক তিনজনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আটক তিনজনের বাড়ি মাগুরায়। সম্পর্কে দুজন মা-মেয়ে, অন্যজন আত্মীয়। তাদের কী উদ্দেশ্যে ভারতে পাচার করা হচ্ছিল, তা আমরা তদন্ত করছি।
নারী ও শিশু পাচার বন্ধে সীমান্তে টহল ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবির মুখপাত্র কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম। তিনি কালবেলাকে বলেন, সীমান্তের যেসব অংশ দিয়ে নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটে, সেসব এলাকায় আমরা টহল ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়েছি। যে কারণে অনেকে সীমান্ত পার হওয়ার সময় আমরা উদ্ধার করছি। একই সঙ্গে পাচারকারীদেরও আটক করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সীমান্ত এলাকায় যারা মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের গতিবিধিও বিজিবি নজরদারিতে রাখে এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হয় বলে জানিয়েছেন শরীফুল ইসলাম। তিনি বলেন, সীমান্ত দিয়ে কেউ যাচ্ছে কি না বা কারও মাধ্যমে পাচারের ঘটনা ঘটছে কি না, সেসব বিষয়ে আমরা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে অভিযান পরিচালনা করি। এতে অনেক নারী ও শিশু পাচারের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। উদ্ধার হওয়া নারী ও শিশুদের থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরে আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পরিবারে ফেরত পাঠানো হয়।
আইনে কঠোরতা থাকলেও সাজা কম: নারী পাচারকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ২০১২ সালে সরকার ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’ আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের অধীনে অপরাধগুলো আমলযোগ্য, আপসের অযোগ্য এবং জামিন অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত। আইনের ৬ ধারায় মানব পাচারের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই ধারা ৭ অনুসারে সংঘবদ্ধ মানব পাচার অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এমনকি, অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা চেষ্টা চালানোর দণ্ড হিসেবে একই আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী, অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই আইনের ১১ ধারা অনুযায়ী পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো ধরনের যৌন শোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের দণ্ড অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
আইনে নারী পাচার বন্ধে কঠোরতা থাকলেও বিচারে সাজা হয় খুবই কম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের বছরজুড়ে বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৩৬টি মামল; ৪১৫টি মামলা খালাস হয়েছে; সাজা হয়েছে ২১টির। এই ২১ মামলায় সাজা হয়েছে ৭১ জনের। মৃত্যুদণ্ড হয়নি কারও। যাবজ্জীবন হয়েছে দুজনের। আর অন্যান্য মেয়াদে সাজা হয়েছে ৬৯ জনের।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান কালবেলাকে বলেন, যে শাস্তির কথা আইনে রয়েছে তা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু, প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হওয়ার জন্য মামলা প্রমাণিত হওয়া প্রয়োজন। তদন্তের দুর্বলতা, সাক্ষী না পাওয়া এবং বিলম্বিত বিচারের কারণে বেশিরভাগ মামলা প্রমাণিত হয় না। যার ফলে এ ধরনের মামলায় সাজার হার অনেক কম।