গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানির (বিএসসিপিএলসি) নিট মুনাফা হওয়ার কথা ছিল প্রায় ১৮৯ কোটি টাকা। সেখানে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা কম মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মুনাফা কম হওয়ায় লভ্যাংশ কম পাচ্ছেন কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানির তথ্য বলছে, আয়কর বেশি হওয়ায় নিট মুনাফা কম হয়েছে।
কিন্তু কালবেলার অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অর্থ আইন ও অফিস আদেশ অনুযায়ী নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ নগদ ব্যয়ের কারণে বেশি আয়কর দিতে হয়েছে। অর্থ আইন অনুযায়ী, কোম্পানির বার্ষিক ব্যয় নগদ অর্থে ৩৬ লাখ টাকা খরচ করা যাবে। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অফিস ব্যয় হিসেবে নগদে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। সেই হিসাবে গত বছরে নির্ধারিত সীমার চেয়ে প্রায় ৯ লাখ টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে।
২০২৩ সালের অর্থ আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থিত এমন কোম্পানির ডিভিডেন্ড আয়ের বাইরে অন্য সব আয়ের ওপর ২০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। তবে কোনো কোম্পানি যদি বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার বেশি ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই
আয়ের ওপর ২২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে।
যেহেতু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ৯ লাখ টাকা বেশি নগদে খরচ করেছে বিএসসিপিএলসি, সেই হিসাবে ওই বছর নির্ধারিত হারের চেয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি আয়কর দিতে হয়েছে। এতে কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮২ কোটি টাকা। তবে নগদ ব্যয় ৩৬ লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে করহার ২০ শতাংশ হতো এবং মুনাফা প্রায় ১৮৯ কোটি টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেত।
মূলত অর্থ আইন উপেক্ষা করে এই অনিয়মিত ব্যয়ের কারণে কোম্পানির মোট মুনাফা থেকে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। আইন অনুযায়ী কোম্পানির পরিচালন ব্যয় করা হলে এই অর্থ তাদের মুনাফায় যোগ হতো এবং কোম্পানি ও শেয়ারহোল্ডাররা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হতেন না।
শুধু অর্থ আইন নয়, এ ক্ষেত্রে অফিস আদেশও উপেক্ষা করা হয়েছে। গত বছর বিএসসিপিএলসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আজম আলী কোম্পানির আয়কর বাবদ উল্লেখযোগ্য অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে নগদ অর্থ ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে একটি অফিস আদেশ জারি করেন। ওই অফিস আদেশে দেখা যায়, কোম্পানির চারটি কার্যালয় নগদ সর্বোচ্চ ব্যয় করতে পারবে সর্বমোট ৩০ লাখ টাকা। এতে কোম্পানির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা ও শেয়ারপ্রতি সর্বমোট প্রায় ৮ কোটি টাকা সাশ্রয়ের প্রক্ষেপণ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অফিস আদেশ উপেক্ষিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অফিস আদেশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি আয়কর সাশ্রয়ের লক্ষ্যে ১১ মাস ধরে সঠিক পথে থাকলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনে এসে বেপরোয়া ব্যয়ে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। জানা গেছে, শুধু জুনেই প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ফলে কোম্পানির মোট নগদ ব্যয় ৩৬ লাখ টাকার সীমা অতিক্রম করে। যার প্রভাব পড়ে কোম্পানির মুনাফায়, দিতে হয় অতিরিক্ত আয়কর।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, নগদ ব্যয়ের একটি বড় অংশ ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে এবং অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকে এবং অডিটেও ব্যয়ের অনিয়ম ধরা পড়ে। এজন্যই মূলত আইন থাকলেও তা অমান্য করে নগদে খরচ করা হয়।
সাবেক এমডি আজম আলী কালবেলাকে বলেন, ‘এটা করা হয়েছিল মূলত কোম্পানির নিট মুনাফা সাশ্রয়ের জন্য। এটার বিষয় হলো অফিস খরচ হিসেবে নগদ ব্যয় কমিয়ে নিট মুনাফার অর্থ সাশ্রয় করা। এটা করতে পারলে কোম্পানি লাভবান হবে, না করতে পারলে লাভ পাবে না। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পরে কেন পারা যায়নি, সেটা বলতে পারব না।’
বিনিয়োগকারীরা জানান, সাবমেরিন কেবলস কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণেই মূলত এমন ঘটনা ঘটেছে। এতে যেমন কোম্পানির মুনাফা কম হয়েছে, একইভাবে বিনিয়োগকারীরাও লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যদি আইন মেনে খরচ করা হতো, তাহলে আড়াই শতাংশ অতিরিক্ত আয়কর দিতে হতো না। এমনিতেই আগের বছরের তুলনায় মুনাফা কম হয়েছে, তার ওপর কোম্পানির ব্যয়ের ক্ষেত্রে এমন স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আস্থা হারাবেন বিনিয়োগকারীরা।
এ বিষয়ে কোম্পানির অর্থ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত এমডি মির্জা কামাল আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি ভালো জানি না। এটা কোম্পানির অর্থ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপকের এখতিয়ার। উনি এটা ভালো বলতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস এমডি পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকার কারণে বিষয়টি আমি অবগত নই। তবে এটা করতে পারলে ভালো হতো।’
জানতে চাইলে উপমহাব্যবস্থাপক (অর্থ) সুকান্ত কুমার দেবনাথ বলেন, ‘এমন একটি অফিস আদেশ ছিল। সেই অনুযায়ী আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নগদে অফিস খরচ নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখতে পারিনি। যদিও এটা বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটা করতে পারলে কোম্পানি লাভবান হতো। আগামী বছরের নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হবে।’
নতুন এমডির দায়িত্ব পাওয়া মো. আসলাম হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ে আমি খোঁজ নিচ্ছি। ক্যাশে অফিস ব্যয় কমানোর জন্য এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছি। কারণ, এতে কোম্পানি লাভবান হবে। অফিস খরচ কেন নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখা গেল না, সেটি খতিয়ে দেখা হবে।’
এদিকে, কালবেলার অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে আরও বেশ কিছু অনিয়মের তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, নিম্নমানের কাজ করলেও বিল পরিশোধে তৎপরতা, নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী এবং তার সংশ্লিষ্টদের কোম্পানির টাকায় চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
প্রধান কার্যালয়ের ডেকোরেশনের কাজে অনিয়ম: ২০২২ সালে প্রায় ২ কোটি টাকা বাজেটে কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের ডেকোরেশনের কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘কসমো বাংলা’। ডেকোরেশনের নামে নিম্নমানের কাজ ও ত্রুটিপূর্ণ মালপত্র সরবরাহ করলেও বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এখানেই থেমে নেই কোম্পানিটির অনিয়ম। প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে অফিস ডেকোরেশনের এক বছর পার না হতেই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইইবি) ভবনে অফিস স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা হয়। তৎকালীন সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামানকে ম্যানেজ করে এই পরিকল্পনা হয়। এজন্য ২ কোটি টাকা অগ্রিম পরিশোধও করা হয়। অফিস স্থানান্তরের কার্যক্রম প্রায় চূড়ান্ত হয়ে এলেও সরকার পরিবর্তনের পর সেই কার্যক্রম থেমে গেছে।
কোম্পানির টাকায় সাবেক মন্ত্রী পলকের চিত্তবিনোদন: সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানির খরচে মন্ত্রীর একান্ত সচিব মুশফিকুর রহমানকে ফ্রান্সের প্যারিস ঘুরিয়ে আনা হয়। এ বিষয়ে সাবেক ভারপ্রাপ্ত এমডি মির্জা কামাল বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা চেয়েছিলাম, কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশ সফরের জন্য তাকে পাঠানো হয়।
অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানির খরচে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে মন্ত্রী ও তার পিএসকে কিনে দেওয়া হয় অ্যাপল ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ। সরকারে পরিবর্তনের আগে কুয়াকাটায় শিকদার রিসোর্টে আপ্যায়নে এক রাতেই ব্যয় করা হয় লক্ষাধিক টাকা। তবে এসব খরচের বেশিরভাগই পরবর্তী সময়ে সমন্বয় করা হয়েছে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে। এ বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, ল্যাপটপ দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, সে কারণে ল্যাপটপ কিনে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, সম্প্রতি বিএসসিপিএলসির নিয়োগ পদোন্নতিসহ নানা অনিয়ম নিয়ে কালবেলায় ‘সাবমেরিন কেবলসের আয় কর্তারাই ভাগ করে খান’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভারপ্রাপ্ত এমডিকে সরিয়ে নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু অভিযুক্ত অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবমেরিন কেবলের অনিয়ম নিয়ে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।