স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রকৌশল সংস্থা। ষাটের দশকে কার্যক্রম শুরু করা এলজিইডি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ এবং হাটবাজারসহ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শহর ও নগর অঞ্চলেও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে। এ ছাড়া নগর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে (পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন) কারিগরি সহায়তা ও পরিচালন ব্যবস্থা এবং দক্ষতা উন্নয়নেও এলজিইডি সম্পৃক্ত।
অবকাঠামো উন্নয়নে ৬০ বছরের অভিজ্ঞ এই সংস্থাটির নিজস্ব প্রকল্প বাস্তবায়নেই এখনো প্রয়োজন হচ্ছে পরামর্শক। সম্প্রতি পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন-সংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্পে ৩১৬ কোটি টাকা পরামর্শক ব্যয়ের আবদার করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এমনকি এ ধরনের কাজ শিখতে প্রকল্পটিতে পরামর্শক, বিদেশে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে স্বয়ং পরিকল্পনা কমিশনও।
জানা গেছে, দেশের ৮৫টি পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটোরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আরইউটিডিপি) শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে এলজিইডি। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা, যার অধিকাংশ ঋণ হিসেবে দেবে বিশ্বব্যাংক। বাকি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের আওতায় পৌরসভার রাস্তা, সেতু, ফুটপাত, ড্রেন, বাজার, বাস টার্মিনাল এবং পার্ক নির্মাণ, স্ট্রিট লাইট স্থাপনসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিজেদের দক্ষতা থাকার পরও ঋণের টাকায় দেশি-বিদেশি পরামর্শক এবং বিদেশ ভ্রমণের পেছনে এত বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা অযৌক্তিক।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে এলজিইডির কাজের গুণগত মান নিয়ে একসময় অনেক সুনাম ছিল। তার মানে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একই কাজ করার জন্য দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও যদি পরামর্শক এবং দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ লাগে, তাহলে যে সক্ষমতা ছিল, সেটা কোথায় গেল। সুতরাং পরামর্শক এবং বিদেশ প্রশিক্ষণের বিষয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটা বৈধ প্রশ্ন। তিনি বলেন, এ ধরনের কাজে কারও যদি পরামর্শ বা প্রশিক্ষণ নিতে হয়, তাহলে তো তারা এলজিইডির কাছেই যাবে। এখন যার কাছে যাওয়ার কথা, সে যদি বলে তার নিজেরই প্রশিক্ষণ লাগবে। তাহলে তো ব্যাপারটা একটু এলোমেলো হয়ে গেল। প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণ লাগলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণের টাকায় পরামর্শক নিয়োগ এবং বিদেশ ঘুরতে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। যদি প্রযুক্তি বদলায়, তাহলে দক্ষতা আরও বাড়ানোর জন্য দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কালভার্ট, স্থানীয় রাস্তা, বাজার, ড্রেনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ বা পুনর্বাসনে প্রযুক্তির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সেখানে দক্ষতা উন্নয়নের খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এগুলো তো এলজিইডির মৌলিক কাজ। যে প্রশ্নগুলো উঠেছে, সেটি যৌক্তিক।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পটি ৮৫টি পৌরসভায় বাস্তবায়ন করা হবে। পৌরসভা এবং এলজিইডির সমন্বয়ে কাজটি হবে। পৌরসভাগুলোর এখনো সে ধরনের অভিজ্ঞতা হয়নি। তাই পরামর্শকের কিছুটা প্রয়োজন রয়েছে। তবে এই প্রকল্পে বিদেশ প্রশিক্ষণ বা পরামর্শক লাগবে কি না, লাগলেও কতটা লাগবে, সেটি যাচাই-বাছাই করা হবে।
তিনি বলেন, একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারাই প্রকল্প প্রস্তাবের পুরো বিষয়টি বাস্তবতার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে দেখবে। তারপর এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে যৌক্তিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, বিদেশ সফর বন্ধ থাকায় এ বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত হবে না।
জানা গেছে, আলোচ্য প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রকল্পের ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করে সংশোধন করে পাঠাতে বলা হয়েছে।
পিইসি সভার কার্যপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্পটিতে পরামর্শক খাতে ৩১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। কার্যপত্রে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সাধারণত পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, ফুটপাত, ড্রেন নির্মাণ, স্ট্রিট লাইট স্থাপন কার্যক্রমগুলো করে থাকে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রস্তাবিত প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব। তার পরও এতসংখ্যক বিদেশি ও দেশি পরামর্শক প্রস্তাবের যৌক্তিকতা আছে কি না, জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। অতিপ্রয়োজন ছাড়া পরামর্শক খাতে যথাযথভাবে ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিদেশে প্রশিক্ষণ খাতে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়ার বিষয়েও একই মতামত পরিকল্পনা কমিশনের। তারা বলছেন, সড়ক, ব্রিজ বা কালভার্ট, ফুটপাত, ড্রেন নির্মাণ, স্ট্রিট লাইট স্থাপন, পার্ক নির্মাণ ইত্যাদি এলজিইডির নিয়মিত কাজ। এই কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। তাই প্রকল্প থেকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাদ দেওয়া যেতে পারে।
প্রকল্পটিতে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বাবদ প্রায় ২০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ কাদের দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সেটিও জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ খাতে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যেটিকে অত্যধিক উল্লেখ করে এ বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
এ ছাড়া এই প্রকল্পের আরও বেশ কিছু খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। যার ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, তদারকির জন্য প্রকল্প সাইটে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু যাতায়াত খাতে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মনে হচ্ছে। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে এলজিইডির নিজস্ব অফিস থাকা সত্ত্বেও যাতায়াত বাবদ বছরে ১ কোটি টাকার ওপরে খরচ হবে, এটি একটু অস্বাভাবিকই।
জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৬১৩টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতসংখ্যক গাড়ি কেনার প্রস্তাবের বিষয়ে আপত্তি রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের। গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে অর্থবিভাগের সুপারিশ ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও এত গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা আছে কি না, সেটি জানতে চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, পৌরসভাগুলোতে আমরা গাড়ি দিতে চাই না। কারণ, পৌরসভাগুলোতে ড্রাইভারের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনার সমস্যাও রয়েছে। এ কারণে আপাতত গাড়ির কথা আমরা ভাবছি না। যাচাই-বাছাই কমিটি গাড়ির প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সেটি জানানোর পর পিইসি সভায় আলাপ-আলোচনা করে ফাইনাল করা হবে।
প্রকল্পের আওতায় অফিস সরঞ্জাম হিসেবে ৪০০ সেট কম্পিউটার বাবদ ৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০টি ল্যাপটপ বাবদ ৪০ লাখ, ১৮টি মাল্টি ফাংশন প্রিন্টার বাবদ ১৮ লাখ, ১০০ ফটোকপিয়ার বাবদ ২ কোটি, ১২টি প্রজেক্টর বাবদ ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া এলজিইডির দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ৩৯০ সেট কম্পিউটার বাবদ ৭ কোটি ৪০ লাখ, একটি মাল্টি ফাংশন প্রিন্টার বাবদ ১ লাখ, একটি ফটোকপিয়ার বাবদ লাখ টাকা, ফার্নিচার বাবদ ৮০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি এবং ফার্নিচার কেনার প্রস্তাবেও আপত্তি রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের। পিইসি সভায় এসব যন্ত্রপাতি কেনার যৌক্তিকতা আছে কি না, সেটি জানতে চাওয়া হয়।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বিগত দুই দশকে উন্নতভাবে বসবাসের জন্য গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য নগর পরিষেবাগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এজন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে মোবাইলে বারবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নকশা প্রণয়ন থেকে শুরু করে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ ঠিকঠাকভাবে বুঝে নেওয়ার জন্য পরামর্শকের প্রয়োজন হয়। তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন, এলজিইডির সমন্বয় করবে। সেক্ষেত্রে পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া বিদেশিরা কীভাবে অবকাঠামোগুলো নির্মাণ করছে সেগুলো দেখারও প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং এটাকে খুব বেশি অতিরিক্ত বা অযৌক্তিক বলা যাবে না। তবে পরিকল্পনা কমিশন যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, সেটা আমলে নিয়ে অপ্রয়োজনীয়গুলো বাদ দিয়ে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে পাঠানো হবে।
মন্তব্য করুন