ঢাকার সরকারি সাতটি কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধীনে থাকছে না। কলেজগুলোকে ঢাবি থেকে পৃথককরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আর ঢাবির অধীনে ভর্তি করা হবে না। গতকাল সোমবার সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঢাবি উপাচার্যের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
উপাচার্যের কার্যালয়-সংলগ্ন অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাবির অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথককরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক বছর এগিয়ে এনে এ বছর থেকেই, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাবির অধীনে ভর্তি না নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সভায় জোর সুপারিশ করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী আসন সংখ্যা, ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাবির চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীন রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল থাকবে, যাতে তাদের শিক্ষাজীবন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তবে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ঢাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদের পদত্যাগের যে দাবি তোলা হয়েছে, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী ভাবছে—জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
এর আগে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিষয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকছে না সরকারি সাত কলেজ। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি পরীক্ষা নেবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাত কলেজকে নিয়ে উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয় গঠন হবে।
এ বৈঠকের আগে দুপুরে ঢাকা কলেজের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাবি ও সরকারি সাত কলেজের মধ্যে সংঘর্ষের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদকে দায়ী করে তার পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানান সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এর পরই সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান। সেখানে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিভিন্ন অনুষদের ডিনসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
রোববার পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় সাত কলেজের একটি দল। সেখানে ঢাবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ শিক্ষার্থীদের অপমান করেন বলে অভিযোগ তোলেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর প্রতিক্রিয়ায় তার ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে সন্ধ্যায় ঢাকা কলেজ সংলগ্ন মিরপুর সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এর জেরে ঢাবি ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ান। তাদের মধ্যকার সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া গভীর রাত পর্যন্ত চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ২০ রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। এর মাঝে পুলিশকে সহায়তা করতে চার প্লাটুন বিজিবিও মোতায়েন করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয় ঢাবি প্রশাসন। সাত কলেজের সব চূড়ান্ত পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়।
সংকট সহসাই কাটছে না: এদিকে সংশ্লিষ্টদের মতে, সাত কলেজকে স্বতন্ত্র কাঠামো দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের জোর প্রচেষ্টার মধ্যেই অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বিশেষ করে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ও বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাগুলো শেষ করা নিয়ে সমস্যা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
এ ছাড়া ঢাবি অধিভুক্ত না থাকলে সেক্ষেত্রে সাতটি কলেজকে নিয়ে কী স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হবে, নাকি একটি বড় কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়ে বাকিগুলোকে অধিভুক্ত করা হবে বা কলেজগুলোয় স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়া হবে— তা এখনো নির্ধারণ হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি এসব নিয়ে কাজ করছে। দ্রুতই একটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে থাকলেও শিক্ষকদের একটি বড় অংশ আবার এর বিপক্ষে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা হলে তারা শিক্ষা ক্যাডারের পদ হারাবেন।
গতকাল ঢাবি উপাচার্যের সঙ্গে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের জরুরি বৈঠকে নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ও অধ্যয়নরতদের শিক্ষাজীবন চালু রাখার বিষয়টিই আলোচনায় বেশি গুরুত্ব পায়। ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে সাত কলেজকে স্বতন্ত্র রূপরেখা দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। ভর্তির প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী, আসন সংখ্যা ও ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
সাত কলেজের মধ্যে একটি কলেজের অধ্যক্ষ গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘সাত কলেজে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তাদের মান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুটা উন্নত। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ছিল, যে কারণে ঘটনা এতদূর গড়াল। কিন্তু আমরা কেউই এই দূরত্ব হটানোর জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিইনি। যখন একটা সমস্যা হলো, তখন ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইস ব্রেক (বরফ গলা) হতে লাগল। তারা অনেক কিছুই মানতে শুরু করে। এটি আরও আগে করলেই বরং ভালো হতো।’
তিনি বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর আমরা অনেকে শিক্ষা ক্যাডার পদ হারিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় হলে আমরা অধ্যক্ষরা কোথায় যাব সেটি জানি না। আমাদের কি ক্যাডার সার্ভিসের দায়িত্বে রেখে সবকিছু করা হবে কি না, তাও জানি না। এ বিষয়ে কিছু জানানোও হয়নি। যদি আমাদের পদমর্যাদার নিচু কোনো পদে দেওয়া হয়, সেটি নিশ্চয়ই আমরা মানব না। আবার কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখার শিক্ষার্থীদের কী হবে? কর্মকর্তা আর মাস্টাররোলের কর্মচারীদের কী হবে? বিশেষজ্ঞ টিমকে এসব বিষয়ও বিবেচনা করতে হবে।’
এই অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই সাত কলেজের সমস্যার সমাধানে কোনো ছক তৈরি করে রেখেছে। নাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে আমাদের ছেড়ে দিত না। তবে সেটি কী, তা আমরা জানি না। সে কারণে আগেভাগেই কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
অন্য একটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলেও যদি ক্যাডার পদ সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে আমাদের আপত্তি থাকবে না। কিন্তু সেটি না হলে আপত্তি জানাব মন্ত্রণালয়ে। যদিও কোনো কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে নাকি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হলে তখন এসব বিষয়ে আমরা কথা বলব।’
আরেকটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, ‘এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সাত কলেজকে যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়েছে, তখনো আমরা শুধু নির্দেশনা মেনেছি। এখনো তেমনটাই করব। তবে আমরা আশা রাখি, মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ টিম নিশ্চয়ই আমাদের অসুবিধার বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।’
এদিকে বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন উপসচিব বলেন, ‘একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছিল বিশেষজ্ঞ কমিটি। হঠাৎ করেই এমন ঘটনা। এখন করণীয় কী, তা ঠিক করা জটিল হবে। শিগগির বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে ভর্তি ও পড়াশোনা কীভাবে চলবে, সেটা কারা পরিচালনা করবে, কীভাবে করবে, বিষয়টি স্পষ্ট করা হবে।’
গত ডিসেম্বরে সরকারি সাত কলেজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ একটি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়ন জন্য চার সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছু হবে। তবে এটুকু বলতে পারি, সরকারের জন্য, সবার জন্য যেটি ভালো হয়, সে অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে।’