ব্যাংক থেকে একটি গোষ্ঠীর লুটপাটের তথ্য আওয়ামী শাসনামলের ১৬ বছরে আড়াল করে রাখা হয়েছিল। নামে-বেনামে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ অনেক আগেই খেলাপি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সরকার-ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান, নজরুল ইসলাম মজুমদাররা প্রভাব খাটিয়ে এসব ঋণখেলাপি করতে দেননি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান। এরপর সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেই খেলাপি এক লাফে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেড়ে পৌনে ৩ লাখে গিয়ে ঠেকে। এ সময় দেশের কার্যরত ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৪৮টিতেই বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ডিসেম্বরের খেলাপি ঋণের হিসাব এখনো প্রাক্কলন করা হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ সময় খেলাপি ঋণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেড়ে প্রায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা হয়েছে, যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। এ সময়ে আটটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ থেকে কয়েক গুণ হয়েছে। এ ছাড়া সাত ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে। সবল ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের আসর পড়েছে।
জানা যায়, সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে লুটপাট থামাতে হাসিনার সরকারের ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত শিল্প গ্রুপ এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোসহ মোট ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে জরিমানা, সতর্কতাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনো পরিচালক বা ব্যাংক এমডি নিজেরাই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এক কথায়, ব্যাংক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে গত ছয় মাসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের অন্তত ৪৮টি ব্যাংকে ৮৭ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা বেড়েছে। তবে এ সময় ৭টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। এতে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। গত জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এ সময়ে সবচেয়ে বেশি খেলাপি বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের। ব্যাংকটির খেলাপি বেড়েছে ১২ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। এর পরের শীর্ষ ৫-এর মধ্যে ৩টি অবস্থানই ধরে রেখেছে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউনিয়ন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। এর মধ্যে ইউনিয়নের খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। আর ফার্স্ট সিকিউরিটির ১০ হাজার ২৫৮ কোটি এবং ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ২৮ কোটি টাকা। খেলাপি বৃদ্ধির দিক থেকে তালিকার পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির খেলাপি বেড়েছে ৫ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। আর ষষ্ঠ অবস্থানে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। খেলাপি বৃদ্ধির দিক থেকে তালিকায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির খেলাপি বেড়েছে ৩ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অষ্টমে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের ২ হাজার ৭৯৩ কোটি, নবমে থাকা রূপালী ব্যাংকের ২ হাজার ২৭২ কোটি এবং দশমে থাকা ব্যাংক এশিয়ার বেড়েছে ২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। একই সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ২৪৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৮১৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ।
উল্লিখিত প্রান্তিকে আটটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ থেকে কয়েকগুণ হয়েছে। এসবের মধ্যে তিনটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ভয়াবহভাবে। ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ থেকে ২৬ দশমিক ৯২ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৩ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ তিন মাসে এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ, মধুমতি ব্যাংকের ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, আল-আরাফাহ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা ২০১৫-১৬ সালের পর একটা উদার পথে চলেছি। তখন থেকে যারা ঋণখেলাপি হয়েছে তাদের অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঋণ পুনঃতপশিলিকরণ, অবলোপন ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সে সময়ে বলা হয়েছিল টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু উদার নীতি কাজে আসেনি, বরং অনেকে সুযোগ নিয়েছেন।’
খেলাপি ঋণের বড় লাফ দেখা গেছে বেসরকারি খাতের সবল ব্যাংকগুলোতেও। ভালো ব্যাংক হিসেবে খ্যাত ব্যাংক এশিয়ার খেলাপি ঋণ ২০২৪ সালের জুন মাসে ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এনআরবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং সিটি ব্যাংকের খেলাপি ২ দশমিক ৯১ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া টাকার অঙ্কে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ৩৯১ কোটি টাকা এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ১৪১ কোটি টাকা।
বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেক বা তারও বেশি খেলাপি হয়ে গেছে এমন ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাতে। এসবের মধ্যে রয়েছে সরকারি খাতের বেসিক ও জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। কারণ অনেক ঋণ পুনঃতপশিল করা হয়েছে, আদালতের স্থগিতাদেশের মধ্যেও খেলাপি ঋণের বড় একটি অংশ আছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতাসীন হয় তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এখন ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয়বার ক্ষমতা নেওয়ার সময়ও খেলাপি ঋণ ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৫১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা হয়। তৃতীয় দফায় ক্ষমতা নেওয়ার সময় ২০১৮ সালের শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত বছর জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ওই সময় মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ খেলাপি ছিল। গত বছর মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল আউয়াল সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন মানলেই তা করা সম্ভব। খেলাপিকারীদের সম্পদ বিক্রি করে খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ আদায় করা সম্ভব। যে কথা গভর্নরও কিছুদিন আগে বলেছেন। খেলাপি ঋণের বড় অংশ শরিয়াহ ব্যাংকগুলোয়। অথচ শরিয়াহ ব্যাংকগুলোয় খেলাপির বিষয়ে কঠোর পলিসি আছে। আমরা যদি পলিসি কার্যকর করার নজির স্থাপন করতে পারি, তাহলে খেলাপিতার সংস্কৃতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকার পতনের পর খেলাপি বেড়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৭৯৫ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের ১ হাজার ৭১৩ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ হাজার ২৫৪ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৬৩৩ কোটি এবং ঢাকা ব্যাংকের বেড়েছে ৫৫২ কোটি টাকা। এ ছাড়া খেলাপি বেড়েছে বিডিবিএল, বেসিক, এবি, কমিউনিটি, যমুনা, মেঘনা, মার্কেন্টাইল, মিডল্যান্ড, মধুমতি, এনআরবি, এনআরবিসি, ওয়ান, প্রাইম, ইউসিবি, উত্তরা, পূবালী, শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের।