মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দরবারে আসিয়া বসিলেন বিরস বদনে। সভাসদবৃন্দ উৎকণ্ঠিত—কী হইয়াছে মহারাজের? রাজজ্যোতিষী, কবিরাজ, কবি, মন্ত্রী, সেনাপতি, অমাত্য, বিদূষক সকলেই অতিশয় চিন্তিত। মহারাজের কী সমস্যা? কী লইয়া তিনি বিচলিত, বিমর্ষ? কাহারও সহিত কোনো প্রকার কথাবার্তা, এমনকি সামান্য কুশলবিনিময় পর্যন্ত করিতেছেন না! একজন অমাত্য একটু গলা খাঁকারি দিয়া বিনীতভাবে প্রশ্ন করিতেই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাহার প্রতি এমন অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করিলেন যে, সেই বেচারার মূর্ছা যাইবার দশা।
দীর্ঘক্ষণ নীরবতা ভাঙিয়া মন্ত্রী করজোড়ে কহিলেন, মহারাজের কি কোনো শারীরিক সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে?
—তেমন কোনো লক্ষণ দেখিতেছ কি?
—না মহারাজ, আপনি তো যথেষ্ট সচল ও বলশালী।
—হুম।
কথা সেখানেই থামিয়া গেল। গোটা পরিষদে আবার নামিয়া আসিল নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সকল পারিষদের উদ্দেশে বলিলেন, গোপাল কোথায়, গোপাল?
গোপাল বিনীতভাবে কহিল, আছি, মহারাজ, আপনার পদতলেই আছি। আজ্ঞা করুন মহারাজ।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আবার কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হইয়া রহিলেন। মন্ত্রী, সেনাপতি, পাত্র-মিত্র, অমাত্য, কবিরাজ, রাজজ্যোতিষী, বিদূষক, বিজ্ঞানীসহ সকলেই আবার বিচলিত ও উদ্বিগ্ন। রাজসভায় পিনপতন নিস্তব্ধতা, শুধু চলিতেছে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি। মহারাজ কিয়ৎকাল চক্ষুবন্ধ করিয়া রহিয়াছেন আবার একটু পর পিটপিট করিয়া সকলের প্রতি দৃষ্টি বুলাইতেছেন। সকলেই অস্বস্তিতে। কিন্তু কেহই টুঁ শব্দটি করিতেছে না। যেহেতু বিষয়টি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে, তাই সকলেই রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষারত, মহারাজ কখন এ নিস্তব্ধতা ভাঙিবেন। কিন্তু সেই প্রতীক্ষার অবসান যেন কিছুতেই হইতে চায় না। গোটা রাজদরবারে নামিয়া আসিয়াছে যেন শ্মশানের নীরবতা।
অনেকক্ষণ অতিবাহিত হইবার পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ‘হুম’ বলিয়া বিকট শব্দ করিলেন। সমগ্র রাজসভা যেমন চমকিত হইল, তেমনি দমবন্ধ পরিবেশ হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া একটু হাঁফ ছাড়িয়াও বসিল। আবার কিয়ৎকাল বিরতি। আবার রাজসভায় নিস্তব্ধতা। তবে উহা আর দীর্ঘস্থায়ী হইল না।
মহারাজ জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলিলেন, তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণ অনুধাবন করিতেছ যে, আমি অতিশয় বিচলিত।
মন্ত্রী উচ্চকণ্ঠে কহিল, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যে অত্যন্ত বিচলিত তাহা কি সকলে বুঝিতে পারিতেছেন?
সকলেই সমস্বরে বলিল, বুঝিয়াছি, বুঝিয়াছি, ধর্মাবতার বড়ই বিচলিত।
এবার মহারাজ সকল পারিষদের প্রতি একে একে দৃষ্টি বর্ষণ করিয়া গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হইয়া রহিলেন কিয়ৎকাল। তারপর উচ্চকণ্ঠে বলিলেন—
শোনো, তোমাদের সকলের নিকট আমি একটি প্রশ্ন উত্থাপন করিতে চাই এবং উহার উত্তর আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দিতে হইবে। সঠিক উত্তরদাতার জন্য স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার হিসেবে রক্ষিত আছে। তবে ভুল উত্তরের জন্য বিভিন্ন প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও কিন্তু থাকিবে।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এই ঘোষণায় রাজসভার সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতে থাকিলেন। মহারাজ যে কাহাকে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নির্দেশ দেবেন, তাহা জানিবার জন্য সকলের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা শুরু হইল। কেহ কোনো প্রকার টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করিতে পারিতেছে না বরং প্রত্যেকেই চেষ্টা করিতেছে নিজেকে কিঞ্চিৎ আড়াল করার জন্য, যাহাতে মহারাজ প্রশ্নটি তাহাকে না করিতে পারেন।
কেহ কোনো কথা বলিতেছে না দেখিয়া অধীর হইয়া মন্ত্রী বিনীতভাবে দুই হাত কচলাইতে কচলাইতে বলিলেন—মহারাজ, আপনি কি আজই প্রশ্নটি করিতে চান, না আগামীকাল সভায় আলোচনা করিবার ইচ্ছা পোষণ করিতেছেন?
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর দিকে তাকাইয়া বলিলেন,
—শোনো মন্ত্রী, আমি কৃষ্ণনগরের মহারাজ হইতে পারি কিন্তু তাহার মানে এই নয় যে, কে কোথায় কী অপকর্ম করিতেছে সে ব্যাপারে আমি অবগত নই। কখনো কখনো ভুয়া প্রজেক্টের কথা বলিয়া তুমি যে কিছু অর্থ পকেটে ঢুকাও, তাহা কি আমি বুঝি না মনে করো?
—মন্ত্রী আমতা আমতা করিতে থাকিল আর পারিষদ কক্ষে রীতিমতো গুঞ্জন শুরু হইল। সকলে অন্তত এটুকু বুঝিল যে, কেউ কোনো কিছু বলিতে গেলে মহারাজ রুষ্ট হইতে পারেন। তাই রাজসভা নীরব হইয়া থাকিল।
মহারাজই সেই নীরবতা ভাঙিয়া বলিলেন,
—প্রশ্নটি সকলে মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করো। প্রশ্ন পাঁচটি, কিন্তু উত্তর হইবে একটিই। আর তা হইতে হইবে এক শব্দে।
—গোটা মন্ত্রিসভা নিস্তব্ধ। সবাই প্রশ্নের আগেই মনে মনে উত্তর খুঁজিতে শুরু করিল। মহারাজ এবার আর একটু খোলাসা করিয়া বলিলেন,
—এই বিষয়টি আমার নহে, মুর্শিদাবাদের নবাবের ফরমান। তিনি দূত মারফত চিরকুট দিয়া জানাইয়াছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে কেহ যদি ভুল করে তবে তাহাকে নবাবের দরবারে পাঠাইয়া দেওয়া হইবে। এ ভুল করার জন্য উত্তরদাতাকে বন্দি করিয়া মুর্শিদাবাদের দরবারে পাঠানো হইবে, নবাব তাহাকে যে কোনো শাস্তি প্রদান করিতে পারেন। তা সে শূলে চড়ানো হইতে শুরু করিয়া যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড হইতে পারে। এমনকি তিনি গর্দান লইতেও বিন্দুমাত্র বিলম্ব করিবেন না।
—মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এ বক্তব্যে গোটা রাজসভা শঙ্কিত এবং ভীত হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া মহারাজ বলিলেন, কই, তোমরা কে কে রাজি, হাত তোলো—
কিন্তু কেহই হাত তোলে না। এবার মহারাজ কঠোর কণ্ঠে কহিলেন,
—ঠিক আছে। আমি পাঁচটি প্রশ্ন করি, তোমরা শোনো—
এক. কোন পাখি চোখ বন্ধ করিয়া ঘুমায় এবং সেই খবর কে জানে;
দুই. কাহাকে একই সঙ্গে প্রাণ দিয়া ভালোবাসা যায় আবার বিষবৎ ঘৃণারও উদ্রেক হয়;
তিন. কে সেই ত্রিকালদর্শী যিনি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা অতি দ্রুত প্রকাশ করিতে পারেন;
চার. কাহার মুখ আছে কিন্তু শব্দ করিতে পারে না, বুক আছে কিন্তু অনুভব করিতে পারে না;
পাঁচ. কে সেই শক্তিমান যাহার জন্য নরনারীর নিদ্রা বিঘ্নিত হয়?
এতটুকু বলিয়া মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সিংহাসনে শরীর এলাইয়া দিলেন। তারপর ধরা ধরা কণ্ঠে কহিলেন,
—শোনো, তোমরা যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নবাব বাহাদুরের এ পাঁচটি উত্তর না দিতে পারো তাহা হইলে শেষ পর্যন্ত নবাব বাহাদুর হয়তো আমারই গর্দান লইবেন। তোমরা কি চাও আমার এইভাবে মৃত্যু ঘটুক?—
সকলে সমস্বরে না না করিয়া উঠিল। কেবল মন্ত্রী মুচকি হাসিয়া মনে মনে বলিল, তবে তো ভালোই হয়। রাজার গর্দান গেলে তো আমাকে আর সামলায় কে; আমি তখন রাজা হইব আর রাজা হইয়াই সব তহবিল একেবারে ফর্সা করিয়া দেব, হে-হে-হে। কিন্তু মুখে বলিল,
—মহারাজ ইহা তো কিছুতেই মানা যায় না। আমরা আপনাকে কিছুতেই হারাইতে চাই না। তাই মন্ত্রী হিসেবে মহারাজ আমার একটা পরামর্শ আছে, আপনি বরং এ জন্য গোপালভাঁড়কে মুর্শিদাবাদে পাঠাইয়া দিন। সে নিশ্চয়ই একটা হেস্তনেস্ত করিয়া ফেলিবে। আর নেহাত যদি সেখানে তাহার প্রাণদণ্ডই হইয়া যায় কিংবা গর্দানই নেওয়া হয়, তাহা হইলে আমরা সারা কৃষ্ণনগরে এক দিন শোক দিবস করিব, কালো পতাকা টানাইব, শোকসভা করিব, এমনকি গোপালের নামে একটি মর্মর মূর্তি গড়িয়া দিব।—
তখন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী উঠিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিলেন,
—এমন হইলে তো শেষ পর্যন্ত গোপালকেই বিসর্জন দিতে হয়। ইহা তো সম্ভব নয়, তাহা হইলে যে কৃষ্ণনগরের রাজসভা অন্ধকার হইয়া যাইবে।—
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন। এবার গোপালভাঁড় অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং খুবই সম্মান প্রদর্শন করিয়া বলিল,
—মহারাজ, আমাদের মন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাহার পেছনে অত্যন্ত ধূর্ত বাসনা রহিয়াছে বলিয়া আমার মনে হয়। তিনি এ সুযোগে আমাকে চিরতরে মহাপ্রস্থানের কথা ভাবিয়া লইয়াছেন। আপনার অবর্তমানে তিনি সিংহাসনে উপবেশন করিবার ইচ্ছা পোষণ করেন। সে ক্ষেত্রে তাহার ভাবনা স্বপ্নপূরণ করিতে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে আমাকেই গণ্য করেন। তবে আমিও গোপলভাঁড়। আমি ষড়যন্ত্রী মহাশয়ের, থুড়ি মন্ত্রী মহাশয়ের প্রস্তুাব গ্রহণ করিলাম। মহারাজ আমাকে মাত্র পাঁচ মিনিট সুযোগ দিন। এখনই উত্তরটা দিয়া দিব।—
এবার মহারাজ উল্লাসে ফাটিয়া পড়িলেন,
—সত্যি গোপাল, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তুমি উত্তর দিয়া দিবে? ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখিয়াছ তো, কী হইবে ইহার পরিণতি?—
গোপাল শান্তভাবেই কহিল, আমি যথেষ্ট ভাবিয়াছি মহারাজ এবং আপনার সঙ্গে কথা বলিতে বলিতে ইহার সমাধানও করিয়া ফেলিয়াছি।—
তাই নাকি গোপাল। তুমি পারো বটে! তবে কী সেই সমাধান, বলো, বলো তুমি গোপাল, আমার তো আর তর সয় না।—
গোপাল রাজদরবারের সকলের উৎসুক মুখের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। তারপর ধীরে ধীরে কিন্তু স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করিল,
—ফেসবুক।—
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন