বাল্যবিয়ে রোধ করতে কিশোরীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিশোরীদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে বাল্যবিয়ের হার কমানো। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণগুলো কাজে আসেনি। প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও এ বিষয়ে সামান্যতম দক্ষতা দেখাতে পারেননি প্রশিক্ষণার্থীরা।
এমনকি প্রকল্পের আওতায় বাল্যবিয়ে মোকাবিলার কারণ অনুসন্ধানে পরিপূর্ণ স্টাডি (মাঠপর্যায়ে অধ্যয়ন) মূল উদ্দেশ্য থাকলেও, সেটা করা হয়নি। দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পরও বাল্যবিয়ে স্টাডি ছাড়াই শেষ করা হয়েছে প্রকল্প। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয়, বরাদ্দের চেয়ে বেশি খরচ; প্রশিক্ষণ, অডিট ও কেনাকাটার কোনো তথ্য সংগ্রহ না করা এবং আর্থিক শৃঙ্খলাপরিপন্থিসহ বিভিন্ন অনিয়ম হয়েছে।
এমন ঘটনা ঘটেছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ‘এক্সিলারেটিং অ্যাকশন টু ইন্ড চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পে। বগুড়া ও জামালপুরের বিভিন্ন উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ করা হয়েছে ৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটি দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও শেষ করতে সময় লেগেছে চার বছর। যদিও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ ধরা ছিল ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১ কোটি ২ লাখ টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে।
বাল্যবিয়ে রোধে নেওয়া মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের আলোচ্য প্রকল্পটি শেষ হয়েছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিয়েছে বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ওই প্রতিবেদনে আলোচ্য প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জিত না হওয়া এবং বাস্তবায়নে নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে অনিয়মের নানা তথ্য তুলে ধরে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এসব অনিয়ম থেকে বিরত থাকার সুপারিশ করা হয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় প্রধান কাজের মধ্যে ছিল বাল্যবিয়ে মোকাবিলার কারণ অনুসন্ধানে পরিপূর্ণ স্টাডি। এ জন্য ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ করা হলেও বাল্যবিয়ে নিয়ে কোনো স্টাডি করা হয়নি। আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের আওতায় সংশোধিত ডিপিপিতে নির্ধারিত স্টাডি না হওয়ায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য যথাযথভাবে অর্জিত হয়নি বলে বলে ধরে নেওয়া যায়।
প্রকল্পের আওতায় কিশোরীদের জীবনমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ৭২টি স্কুলে কিশোরী রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করা হয়। এখানে ৪ হাজার ৩২০ জন মেয়েকে জীবনমুখী দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিষয় এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এজন্য খরচ করা হয়েছে ৭০ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। তবে আইএমডির পরিদর্শন প্রতিবেদন বলছে, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কার্যকর হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অধিকাংশ মেয়েই কোনো ধরনের কম্পিউটার দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেনি। এর কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ মেয়েই অসচ্ছল পরিবারের। তাদের বাড়িতে কম্পিউটার নেই। তাই চর্চার অভাবে ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের পরিবর্তে দুই মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন।
প্রকল্পের মোট খরচ কমলেও আন্তঃঅঙ্গ সমন্বয় না করেই এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কিশোরী রিসোর্স সেন্টার স্থাপন খাতে বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। তবে খরচ করা হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দের চেয়ে এই খাতে ৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে।
এ ছাড়া কন্টিনজেন্সি স্টাফ (অনিয়মিত কর্মী) খাতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, কিন্তু খরচ করা হয়েছে ৩ লাখ ৩ হাজার টাকা। টেলিফোন, মডেম এবং ইন্টারনেট খাতে বরাদ্দের চেয়ে দেড় লাখ টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে। স্টেশনারি ও অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত ১ লাখ ৩৯ হাজার টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে।
আইএমইডি বলছে, বরাদ্দের চেয়ে বেশি খরচ করা হলেও মানা হয়নি আইন। আলোচ্য প্রকল্পের এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপিতে উল্লিখিত খাতওয়ারি প্রাক্কলিত ব্যয়ের সঙ্গে পিসিআরের মোট ব্যয়ের মিল রয়েছে। তবে সংশোধিত ডিপিপি বিভিন্ন খাতের ব্যয়ের সঙ্গে পিসিআরে উল্লিখিত ব্যয়ের অনেকাংশেই মিল নেই। আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় না করেই খাত পরিবর্তন করা আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থি। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জানাতে হবে।
এ ছাড়া জেলা অফিসগুলোয় প্রকল্পের প্রশিক্ষণার্থীদের তালিকা এবং ব্যয় বিবরণীর অধিকাংশ তথ্য সংরক্ষণ করা নেই। প্ৰশিক্ষণ সম্পর্কিত তথ্য প্রকল্প সমাপ্ত রিপোর্টে (পিসিআর) বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা নেই। কেনাকাটা এবং অডিট আপত্তি-সংক্রান্ত কোনো তথ্য পিসিআরে উল্লেখ নেই। আইএমইডি বলছে, অডিট আপত্তি-সংক্রান্ত তথ্য ছাড়া সমাপ্তি প্রকল্পের যথাযথ মূল্যায়ন করা কঠিন। প্রকল্পের সব অডিট আপত্তির বর্ণনা ও বিস্তারিত জবাব দিতে হবে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রকল্পের অনিয়মগুলো তুলে ধরে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি। একই সঙ্গে অতিরিক্ত ব্যয় এবং উল্লিখিত অসংগতিগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে আইএমইডিকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাখ্যা জানানোর কথা বলা হলেও এখনো সেটা দিতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর।
এদিকে বাল্যবিয়ে রোধে নেওয়া প্রকল্পটি ফলপ্রসূ না হওয়া সত্ত্বেও দ্বিগুণ ব্যয়ে আরও একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। ২০২৩ সালে নেওয়া প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রেও প্রকল্প প্রণয়নে সরকারি পরিপত্র যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। প্রথম পর্যায়ের মতো ‘এক্সিলারেটিং অ্যাকশন টু অ্যান্ড চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকও অধিদপ্তরের একই কর্মকর্তা। এ বিষয়ে আইএমইডি জানিয়েছে, একই ধরনের প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় গ্রহণের সময় আগের প্রকল্পের ওপর আইএমইডির অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি সংক্রান্ত পরিপত্র যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থিসহ অসংগতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও অধিদপ্তরের গবেষণা কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পটি অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। এত বছর পর সব তথ্য পাওয়া কিছুটা কঠিন। আইএমইডি যে অসংগতিগুলো তুলেছে সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে অসংগতিগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প নেওয়ার আগে আইএমইডির মতামত না নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পটি অনেক ছোট। এটা মন্ত্রী অনুমোদন করে দিয়েছিলেন। সেজন্য হয়তো মতামত নেওয়া হয়নি।