আতাউর রহমান
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৫, ০৮:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘মব’ নামের সহিংসতা চলছেই

বারবার হুঁশিয়ারিতেও থামছে না কেউ
‘মব’ নামের সহিংসতা চলছেই

রাজধানীর মগবাজারের টিঅ্যান্ডটি কলোনি এলাকায় গত বুধবার রাতে একদল লোক প্রকাশ্যেই অস্ত্রের মহড়া দেয়। এরপর এলাকার মাইকে সেই সন্ত্রাসীদের ধরতে আহ্বান জানানো হয়। লোকজন বেরিয়ে ঘটনাস্থল থেকে মাহফুজুর রহমান বিপু নামে একজনকে গণপিটুনি দেয়। এর আগের রাতেই অভিজাত গুলশান এলাকায় মব তৈরি করে একটি বাড়িতে রীতিমতো তাণ্ডব চালানো হয়, বাড়িটিতে চলে লুটপাট। শুধু ঢাকাতেই নয়; দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা অজুহাতে, নানা গুজব ছড়িয়ে এই মব সৃষ্টি করে গণপিটুনির মতো নিষ্ঠুরতা দেখানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও ছিনতাইকারী বানিয়ে, ডাকাত বানিয়ে পিটিয়ে হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। সম্প্রতি গুজব ছড়িয়ে মব তৈরি করে বাসাবাড়িতে ঢুকে তাণ্ডবের মতো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। এমন বিশৃঙ্খলা যে বেড়ে গেছে, তা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

যদিও সরকারের উপদেষ্টা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বারবারই এই মবের নামে বিশৃঙ্খলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তবে পরিসংখ্যান বলছে, সরকারের এই হুঁশিয়ারিতে যেন কেউই সতর্ক হচ্ছে না।

মব জাস্টিস যে কমছে না, সে বিষয়ে স্বীকার করে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি দ্বিমত করব না, হচ্ছে। তবে যেখানে হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। পুলিশের ওপরও হামলা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করতে হবে। জনগণ এমন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেলে অনেক সময় কিন্তু সমস্যা হয়। বাহিনী দিয়ে তো সবসময় কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণ) করা যায় না। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা (মব) না ঘটে, সেজন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

সরকারের আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বন্ধে কঠোর বার্তা দিয়েছিলেন। ১০ ফেব্রুয়ারি নিজের ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাহলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট করা হবে।’

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে ‘গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষকে হত্যা ও নির্যাতনের’ ঘটনা বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ‘গণপিটুনির’ অন্তত ৩০টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন। গত বুধবার বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাটি এই তথ্য জানায়।

এইচআরএসএসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৭ মাসে ‘গণপিটুনির’ অন্তত ১১৪টি ঘটনায় কমপক্ষে ১১৬ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৭৪ জন। এ ছাড়াও ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে ‘গণপিটুনির’ অন্তত ১০০৯টি ঘটনায় কমপক্ষে ৭৯২ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৭৬৫ জন। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১০ বছরের মধ্যে গত বছর গণপিটুনির অন্তত ২০১টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৭৯ জন নিহত হন এবং আহত হয়েছেন ৮৮ জন, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয়ানক ছিল। ২০১৫ ও ২০১৬ সালেও গণপিটুনিতে বেশি মানুষ নিহত হন, ওই দুই বছর ২৩২ জন নিহত হন।

মানবাধিকার সংগঠনটি বলছে, দেশের মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এসব ঘটনায় (গণপিটুনি) থানায় হত্যা মামলা বা এফআইআর হলেও সুষ্ঠু তদন্ত বা অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের ঘটনা খুবই কম। দোষীরা আইনের আওতায় না আসায় দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, ফলে দোষীরা অধরাই রয়ে যাচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী সন্দেহেও গণপিটুনির পাশাপাশি ছেলেধরার অভিযোগেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি দলবদ্ধভাবে হামলার ঘটনা বেড়েছে, যা এরই মধ্যে ‘মব’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার ও রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারেও গুজব ছড়িয়ে মব তৈরি করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার শুরুর দিকে এ ধরনের মবকে মানুষের রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হলেও গত ছয় মাসেও তা না থামায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ‘ডাকাত পড়ার’ ঘোষণা দিয়ে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন শরীয়তপুরে ডাকাত সন্দেহে পাঁচজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে রাজধানীর উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ২ মার্চ ভোলার চরফ্যাসনে চুরির অভিযোগ তুলে শাহজাহান মিন্টিজ (৪০) নামে এক যুবকের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে হাত-পা ভেঙে দুই চোখ তুলে ফেলা হয়। ওই ব্যক্তিকে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া কালবেলাকে বলেন, ছিনতাইকারী সন্দেহে আগুনে পুড়িয়ে মারা, গ্রামবাসীর মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মারা—এসব বিগত সরকারের আমলে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আমরা বিচারের নামে আইন হাতে তুলে নেওয়া এবং অধিকতর ভয়ানক ফৌজদারি অপরাধের পুনরাবৃত্তি চাই না।

তিনি বলেন, দেশের বিচার ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে হবে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। মব বা গণপিটুনিতে জড়িত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আওতায় বিচার লাভ এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষীসাব্যস্ত করা যাবে না ও অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি বা ভিন্ন কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। এর ব্যতিক্রম করলে দণ্ডবিধি ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে; কিন্তু অপরাধ প্রমাণ না হতেই মব সৃষ্টি করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, যা বড় অপরাধ। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণপিটুনি মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গোপনে বিয়ে করলেন জিয়া মানেক

উপদেষ্টা মাহফুজের বাবা ইউনিয়ন বিএনপির সম্পাদক নির্বাচিত 

রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে একই পরিবারের দগ্ধ ৩

উড্ডয়নের সময় এফএ-১৮ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত, ককপিটে ছিলেন ২ পাইলট

ভবদহের চার দশকের দুঃখের অবসান হতে যাচ্ছে

এইচএসসি পাসেই এনজিওতে চাকরির সুযোগ

সালমানকে নিয়ে অভিমান প্রকাশ করলেন ঐশ্বরিয়া

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির প্রথম ভর্তি পরীক্ষা আজ

এশিয়া কাপে কোন বোলারকে মিস করবে ভারত, জানালেন হরভজন

গণমাধ্যমের নামে ভুয়া ফেসবুক পেজে বিভ্রান্তি

১০

ধূমপান না করেও ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে, যে লক্ষণ দেখে বুঝবেন

১১

ডাকসুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কারা এগিয়ে 

১২

ডাকসুর ভিপি-জিএস প্রার্থীদের পরিচয়

১৩

কলম্বিয়ায় হেলিকপ্টার ও বিমানঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ১৮

১৪

১১ দল নিয়ে চট্টগ্রামে শুরু হচ্ছে রিজিওনাল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট

১৫

হঠাৎ কেন মোবাইলের ডায়াল প্যাডে পরিবর্তন

১৬

বাংলাদেশি পোশাক খাতে দুই মাসে ক্রয়াদেশ বেড়েছে ৩২ শতাংশ

১৭

গরম পানি পান করলে কি সত্যিই ওজন কমে

১৮

অবশেষে বিচ্ছেদ নিয়ে মুখ খুললেন সোহেল খান

১৯

কীভাবে যৌবন ধরে রেখেছেন রোনালদো, বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ

২০
X