আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও মার্কিন নতুন ভিসা নীতিসহ নানামুখী তৎপরতার পর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে এবার শুরু হয়েছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে লাকুয়ার বাংলাদেশ সফরের আগে এ ধরনের তৎপরতাকে গুরুত্ব দিয়েই দেখছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
তাদের দাবি, বিএনপি কূটনৈতিকভাবে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে। তারাই এখন শান্তিরক্ষা মিশনকে টার্গেট করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতির নেপথ্যেও ভূমিকা রাখছে বিএনপি। তবে এ ধরনের অভিযোগ নাকচ করে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার জন্য সরকারের কর্মকাণ্ডকেই দায়ী করছেন বিএনপি নেতারা।
ঢাকা ও নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ, কানাডা ও উরুগুয়ের যৌথ আয়োজনে আগামী ২৫-২৬ জুন ঢাকায় ‘শান্তিরক্ষা মিশনে নারী’ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এ সম্মেলনে যোগ দিতে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল (পিস অপারেশন) জ্যঁ পিয়েরে লাকুয়া এবং আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল (ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি, পলিসি ও কমপ্লায়েন্স) ক্যাথেরিন পোলার্ড দু’দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন। সফরের সময় সম্মেলনের পাশাপাশি তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
এদিকে, জ্যঁ পিয়েরে লাকুয়ার ঢাকা সফর সামনে রেখে গত ১২ জুন একটি বিবৃতি দিয়েছেন এইচআরডব্লিউর চিফ অ্যাডভোকেসি অফিসার ব্রুনো স্ট্যাগনো। বিবৃতিতে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারিকে তার সফরকালে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অন্তর্ভুক্ত করার আগে অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে কি না তা যাচাই করার আহ্বান জানানো হয়।
এই বিবৃতিতে বলা হয়, পিয়েরে এমন এক সময়ে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন যখন দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিকবিরোধীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, অধিকার কর্মী ও জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে টার্গেট করছে, রোহিঙ্গাদের হয়রানি করছে। তাই পিয়েরের বাংলাদেশ সফরের সময় সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নির্যাতনের বিষয়ে প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ সুনামের সঙ্গে ভূমিকা রেখে আসছে। বাংলাদেশ শান্তি মিশনে সবচেয়ে বড় সৈন্য প্রেরণকারী দেশ। হঠাৎ করে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন তোলা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ নয়। এই তৎপরতার পেছনে দেশের ভেতরকার কোনো রাজনৈতিক শক্তির ইন্ধন রয়েছে। এজন্য সরাসরি বিএনপিকে দায়ী করছেন সরকারদলীয় নেতারা।
তবে বিএনপি কখনোই দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতা চালায় না দাবি করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপি এখন একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল। জনগণের জন্যই বিএনপির রাজনীতি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এ দলটি একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেছে। জনগণের দাবি নিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা রাজপথে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করছি। জনসম্পৃক্ত আন্দোলনেই আমরা দাবি আদায় করতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণই বিএনপির সকল ক্ষমতার উৎস। দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড বিএনপি কখনো করেনি, আগামীতেও করবে না। আমাদের কথায় বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সৈন্যদের নিয়ে যাবে কিংবা বন্ধ করে দেবে—এটা যদি কেউ চিন্তা করে, এর থেকে ভিত্তিহীন চিন্তা, অলীক চিন্তা আর কী হতে পারে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কী ক্ষমতা থাকতে পারে যে, শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈনিক নেবে কি নেবে না—এটা বলার।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই এইচআরডব্লিউ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এর আগে সংস্থাটি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারেও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী তাদের পক্ষে বিবৃতি দিতে বিপুল অর্থ দিয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অভিযোগ উঠেছিল। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হওয়া যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে সেই সময় ড. কামাল হোসেনের জামাতা ডেভিড বার্গম্যান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ হয়ে কাজ করেন। তিনি এই বিচারের বৈধতা নিয়ে এবং বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ ছাড়াও বিএনপিপন্থিদের দুটি প্রতিষ্ঠান অধিকার এবং মায়ের ডাকের তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে এইচআরডব্লিউর বিরুদ্ধে মনগড়া প্রতিবেদন তৈরি এবং তা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। সেসব বিভ্রান্তিমূলক প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের আমলে নেওয়ার প্রবণতাও দৃশ্যমান হচ্ছে। সবশেষ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনেও এইচআরডব্লিউর নাম উল্লেখ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করে, দীর্ঘদিন ধরেই সরকারকে চাপে ফেলতে বিরোধী পক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। বিষয়গুলো সরকার গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়া এবং বিরোধীদের প্রচেষ্টা জোরদার হওয়ায় র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, মার্কিন ভিসা নীতিসহ সরকারের ওপর নানা চাপ আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার শান্তিরক্ষা মিশনের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যা কিছুই হচ্ছে তা যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করছে। দেশটি বরাবরই বিএনপি-জামায়াত শক্তিকে প্রমোট করে। তারা জানে, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের মধ্যেও আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, তা আর কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও তারা আওয়ামী লীগ সরকার চায় না।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এটি স্পষ্টভাবে বলেছেন। এই প্রথম প্রভাবশালী ও শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের অবন্ধুসুলভ ও অরাজনৈতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান কথা বললেন। সরকারের পক্ষ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে বলতে হবে, বোঝাতে হবে দেশটি ভুল করছে। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ও এর জনগণকে টার্গেট করছে।’
ওয়াশিংটনের কাছে এই বার্তা বোধগম্য করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতাও সর্বোচ্চ ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই বর্ষীয়ান কূটনীতিক।
যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) ও এর ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়। গত দেড় বছরেও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে বাইডেন প্রশাসন। এইচআরডব্লিউর বিবৃতি দেওয়ার দিনেই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু এবং পক্ষপাতহীন অনুষ্ঠানের জন্য ভূমিকা রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য চিঠি দেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে গত ২৫ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে ছয় রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান চিঠি পাঠায় এবং গত ৮ জুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকেও ডেমোক্রেট ছয় কংগ্রেস সদস্য চিঠি দিয়েছেন।
মন্তব্য করুন