অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ না পাওয়ায় সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিসেম্বরে নির্বাচন চাওয়া বিএনপি। এ জন্য নতুন কৌশলও নিয়েছে তারা। এ লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র এবং নির্বাচন বর্জনকারী যুগপতের বাইরের দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবে দলটি। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আজ শনিবার ১২ দলীয় জোট ও এলডিপির সঙ্গে পৃথক বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হবে। এক থেকে দুই সপ্তাহব্যাপী এসব বৈঠক শেষে দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের নিয়ে চলতি মাসের শেষদিকে কিংবা আগামী মাসের শুরুতে ঢাকায় বড় একটি সংবাদ সম্মেলন করবে বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে সরকারকে তারা এই বার্তা দেবে যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত এবং তারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরির মাধ্যমে সরকারের ওপর পরোক্ষ ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ অব্যাহত রাখবে দলটি। গত বৃহস্পতিবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রমতে, নির্বাচন ইস্যুতে সরকার আগামী দু-এক মাসের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কী পদক্ষেপ নেয়, সেটা পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি। দলটির শঙ্কা, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও চাওয়া উপেক্ষা করে সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে, দেশ অস্থিতিশীল হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়াতে প্রয়োজনে কর্মসূচির দিকেও যেতে পারে তারা।
বিএনপি কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের সময় ও পথনকশা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিল। এমন অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা জানান, ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের আগে কম সংস্কার চায়, তাহলে নির্বাচন ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে। আর যদি একটু বেশি সংস্কার চায়, তাহলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে প্রধান উপদেষ্টার এই ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে বিএনপি একমত ছিল না। দলটি মনে করে, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এর বেশি হলে তা হবে সময়ক্ষেপণ। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দু-একজন উপদেষ্টা এবং দু-একটি দলের একেক রকম বক্তব্যে নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয় বিএনপিতে। দলটি আরও মনে করে, গুম-খুন ও গণহত্যায় জড়িতদের বিচার এবং সংস্কার কার্যক্রমও সেভাবে এগোচ্ছে না। একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেগুলোও গুছিয়ে আনছে না সরকার।
এমন অবস্থায় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ইস্যুতে গত বুধবার সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছে বিএনপি। সেখানে নির্বাচনের সময়-তারিখ বা সুনির্দিষ্ট পথনকশার (রোডম্যাপ) বিষয়ে স্পষ্ট হতে চেয়েছিল দলটি। কিন্তু সরকার থেকে সুনির্দিষ্ট বার্তা তারা পায়নি। বরং ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে, প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে হতাশ হয়েছে তারা। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে তারা একেবারেই সন্তুষ্ট নয়। তারা সরকারকে এটাও স্পষ্ট করে বলেছেন যে, তাদের কাটঅফ টাইম হচ্ছে ডিসেম্বর। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে দলের নীতিনির্ধারকদের বৈঠক ডাকে বিএনপি। এই বৈঠকের মূল এজেন্ডাই ছিল ড. ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিএনপির বৈঠক। জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে কী আলাপ-আলোচনা হয়েছে, শুরুতে বিএনপি মহাসচিব নিজেই তা ব্রিফ করে জানিয়েছেন। এরপর নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের যে মনোভাব-দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার সেটা বৈঠকে তুলে ধরেন। নেতাদের কাছে মনে হয়েছে, সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী জুনের কথা বললেও নির্বাচন নিয়ে তারা অনেকটাই উদাসীন। নির্বাচন নিয়ে সরকারের মধ্যে কোনো সিরিয়াসনেস তারা দেখতে পাননি। উপদেষ্টাদের যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, তাতে মনে হয়েছে, নির্বাচন জুন পেরিয়ে আগামী বছরের ডিসেম্বরে চলে গেলেও সরকারের কোনো সমস্যা নেই; অর্থাৎ নির্বাচন ইস্যুটাকে সরকার এখনো কার্যত আমলে নিচ্ছে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, তারা যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি করছেন এবং এটি দেওয়া যে জরুরি, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন বলে বৈঠকে তাদের মনে হয়নি। বরং তাদের মনে হচ্ছে, সরকারের ভেতরের কোনো একটি পক্ষ নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়। সুতরাং আমরা যদি সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত না রাখি, তাহলে নির্বাচন জুন নয়, আগামী বছরের ডিসেম্বরেও চলে যেতে পারে।
বৈঠকে বিএনপি নেতারা অভিমত দেন, এই সরকার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। সুতরাং এদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো কর্মসূচি কিংবা বড় আন্দোলনে যাওয়া যাবে না। সে পরিস্থিতিও এখনো আসেনি। একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করছেন তারা। সুতরাং তারা চান না এই সরকার ব্যর্থ হোক। সামগ্রিক বিবেচনায় তাই সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী আগামী রোজার আগেই নির্বাচন দাবি করেছে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। জামায়াতের এমন অবস্থানকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে বিএনপি। দলটির কেউ কেউ বলেন, বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলেও তা এক-দেড় মাস পেছালেও সেটা তেমন কোনো ব্যাপার না। এ ক্ষেত্রে তাদের তেমন আপত্তি থাকবে না। তবে সেটা অবশ্যই জুন না। স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্বাচনী সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ইস্যুতে বিএনপি এবার জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করবে।
বিএনপির নেতৃত্বে আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে শুরুতে সম্পৃক্ত ছিল জামায়াত, যেটা ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর শুরু হয়। দুটি কর্মসূচিও দলটি যুগপতভাবে পালন করে। পরে মতপার্থক্যের কারণে যুগপৎ থেকে বেরিয়ে দলীয় কর্মসূচি নিয়ে পৃথকভাবে সরকারবিরোধী পুরো আন্দোলনজুড়ে মাঠে ছিল জামায়াত। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নির্বাচনী ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বৈপরীত্য দেখা দেয়। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বিপরীতমুখী বক্তব্য রাজনীতিতে উত্তাপও ছড়ায়। বিএনপি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। অন্যদিকে জামায়াত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তারপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাচ্ছিল। এখন জামায়াত বলছে, তারা আগামী রমজানের আগেই সংসদ নির্বাচন চায়। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে দলটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের বৈঠকের পর নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের সুর বদলেছে। এর মধ্য দিয়ে জামায়াত আবার বিএনপির সঙ্গে নতুন কোনো বোঝাপড়ায় এসেছে কি না, সে বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে।
মন্তব্য করুন