বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে কেটে যেতে পারে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সৃষ্ট সংকট। বিএনপির পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলও এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ বৈঠককে সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্যই ‘সুযোগ’ বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং আগামী নির্বাচনে তাদেরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই সরকারের জন্য নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার ইস্যুতে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মনোভাব বোঝা খুব দরকার। অন্যদিকে সরকার কী করতে চায়, সেটাও তারেক রহমানের জানা দরকার। আর তার জন্য এ বৈঠকটি হবে উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম। আগামীকাল শুক্রবার লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে হোটেল ডোরচেস্টারে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেটিকে যৌক্তিক মনে করছে না বিএনপি। দলটি মনে করে, নির্বাচনের জন্য চলতি বছরের ডিসেম্বরই উপযুক্ত সময়। তবে নির্বাচন আগামী বছরের জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ রোজার আগে হলেও দলটির আপত্তি থাকবে না বলে বিএনপির অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র আভাস দিয়েছে বলে জানা গেছে। দলটির অভিমত, সর্বোচ্চ এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তারেক রহমান এ বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
গত কয়েক মাসে ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের রায় আসার পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানো, এটাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে রাজধানীতে অচলাবস্থা তৈরি এবং এর রেশ ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) সঙ্গে বিরোধে জড়ানোসহ সরকারের সঙ্গে এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয় বিএনপির। এমন পরিস্থিতিতে গত ২৮ মে নয়াপল্টনে বিএনপির বড় সমাবেশ থেকে তারেক রহমান স্পষ্টভাবেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে।
দলটির অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র মতে, এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য দুই মাস দেখার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এ সময়ের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে কিংবা নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার কোনো লক্ষণ ফুটে উঠলে দাবি আদায়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে আগামী জুলাই থেকে মাঠের কর্মসূচিরও পরিকল্পনা করছিল দলটি।
বিএনপির এমন অনড় অবস্থানের মধ্যে ঈদুল আজহার আগের দিন গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যে কোনো দিন। প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের পর ওই রাতেই স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে সরকারের এ ঘোষণার কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। সেখানে দলটির পক্ষ থেকে এপ্রিলে নির্বাচনের বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
স্থায়ী কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হলে একদিকে আবহাওয়ার সংকট এবং অন্যদিকে রমজানের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা ও কার্যক্রম এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সরকার ও বিএনপির মধ্যে এমন টানাপোড়েনে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘিরে সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। আদৌ এপ্রিলে নির্বাচন হবে কি না, কিংবা নির্বাচন কবে হবে—তা নিয়ে বিএনপিতে এক ধরনের শঙ্কাও তৈরি হয়। এমন অবস্থায় ঈদের দিন গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় গিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সূত্রমতে, শুভেচ্ছা বিনিময়ের একপর্যায়ে সরকার ঘোষিত নির্বাচনের নতুন রোডম্যাপের বিষয়টি উঠে আসে। তখন খালেদা জিয়া জ্যেষ্ঠ নেতাদের নির্বাচন ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সরাসরি কোনো ধরনের বিরোধে না জড়ানোর নির্দেশনা দেন। নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গেলে বিএনপির কোনো লাভ নেই। তাই বিরোধ নয়, সংকট সমাধানে আলোচনাই শ্রেয়। সে পথেই হাঁটতে হবে। যদি ড. ইউনূস না থাকেন, তাহলে কী হবে, সেটাও তো ভাবতে হবে। তাই যুক্তির আলোকে কীভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ এগিয়ে নিয়ে আসা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। খালেদা জিয়ার এমন নির্দেশনায় বদলে যায় বিএনপির রাজনীতির দৃশ্যপট। ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবিতে দলীয় কঠোর অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয় হয়ে বিএনপি এখন যৌক্তিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সংকট সমাধানের পথে এগোচ্ছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা থেকে শুরু করে সব স্তরের নেতাকর্মীরা এখন লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠেয় বৈঠকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সবার প্রত্যাশা, এ বৈঠক থেকে একটা ইতিবাচক ফল বেরিয়ে আসবে। আর এ বৈঠকের পরেই বিএনপি তাদের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।
জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার এবং বিচার—মূলত এ তিন ইস্যু প্রাধান্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও মূল ফোকাস থাকবে ডিসেম্বরে নির্বাচনের ওপর। তবে ডিসেম্বরে না হলে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থাৎ রোজার আগে যাতে নির্বাচনটা হয়ে যায়, সে বিষয়টিতে তারেক রহমান সর্বোচ্চ জোর দিতে পারেন বৈঠকে।
অন্যদিকে সরকারি সূত্র বলছে, সরকারও কেন আগামী এপ্রিলে নির্বাচন করতে চায়, সেটা ড. ইউনূস তার ভাষণে যেমন তুলে ধরেছেন, সংস্কার এবং বিচারের পাশাপাশি তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকেও এ বিষয়টি তিনি তুলে ধরবেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যদি সেটাতে কনভিন্সড হন, তাহলে এপ্রিলে নির্বাচন হতে পারে। এ ছাড়া বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে সূত্র বলছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গোটা জাতি এখন লন্ডনের দিকে তাকিয়ে। বিশ্বাস করি, এটি হবে ঐতিহাসিক বৈঠক এবং এ বৈঠকের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে। তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে ডিসেম্বরে নির্বাচনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে বিএনপি। যৌক্তিক সময়েই নির্বাচন হবে বলে জাতি প্রত্যাশা করে। আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনসহ সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বৈঠকটিকে সরকার এবং বিএনপি উভয়ের জন্যই ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সংস্কারের বিষয়ে সরকারের অবস্থান, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, দেশকে স্থিতিশীল রাখা, বিএনপির সঙ্গে সরকারের কোনো দূরত্ব নেই অর্থাৎ একটা ঐক্য অবস্থা প্রকাশ করা—এগুলো সবই এখন সরকারের জন্য প্রয়োজন। তাছাড়া এ অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদ্যমান অবস্থা থেকে বের হয়ে একটা নির্বাচিত স্বাভাবিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিতে হবে। এমন অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে শুক্রবার অনুষ্ঠেয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সুতরাং এ সরকারের জন্য সেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মনোভাবটা বোঝা দরকার। যদিও ঢাকায় বিএনপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সরকারের একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে তাদের কেউ দলটির হাইকমান্ড নন। হাইকমান্ডের সঙ্গে কথা বলা আর অন্যদের সঙ্গে কথা বলা এক রকম না। সেই জায়গা থেকে বলতে গেলে সরকার একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার যেসব কাজ করতে চান অর্থাৎ তারা দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করছেন, তারা জাতিকে একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে চান, পাশাপাশি সংস্কার ও গণহত্যার বিচারেরও উদ্যোগ নিয়েছেন—এগুলো করার ক্ষেত্রেও সরকারের বিএনপির সহযোগিতা দরকার। কারণ, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় দল। তাই সরকারের জন্য বিএনপির সহযোগিতা চাওয়া, বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসা খুব দরকার। এককথায় সরকারের সাফল্যের জন্যও বিএনপির সহযোগিতা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক এ বিশ্লেষক বলেন, সরকার উদ্যোগ নিলেও এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিএনপির জন্যও একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ও সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে দলটির যে একটু মতবিরোধ আছে, পাশাপাশি গণহত্যার বিচার—এসব ইস্যুতে তারা কী চায়, সেটা কীভাবে করতে চায়—এ ক্ষেত্রে আলোচনা করে সরকারকে বিএনপির মনোভাবটাও বোঝাতে পারে। এর মধ্য দিয়ে দুপক্ষেরই কাছাকাছি আসা সম্ভব।
ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যেরও একটা সূচনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে একটা বার্তাও যাচ্ছে যে, বিএনপি ও সরকার পথ চলছে একসঙ্গে। না হলে তো তারা বসত না। আর বসার মানেই হলো এখানে একটা ইতিবাচক দিক আছেই।
মন্তব্য করুন