হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ‘অস্বাভাবিক’ আগাম জামিন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সুনামগঞ্জে সংঘটিত ঘটনায় দায়ের করা দুটি হত্যাচেষ্টার মামলাও রয়েছে। এ দুটি মামলার এফআইআরে আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উল্লেখ রয়েছে। তবে আগাম জামিন মঞ্জুর করে দেওয়া আদেশে আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালতে বেইল বন্ড (জামিননামা) দাখিল করার পর থেকে এসব মামলার আসামিদের ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। হাইকোর্টের দেওয়া ‘অসত্য’ পর্যবেক্ষণের আলোকে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ওইসব আসামির জামিন আবেদন বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া মাগুরার একটি হত্যা মামলায় আসামিদের আগাম জামিন আবেদনের শুনানি তিন মাস মুলতবি রেখে তাদের গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীক মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়। হাইকোর্টের এসব আদেশ ও পর্যবেক্ষণ আগাম জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের দেওয়া নীতিমালার লঙ্ঘন বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
জানা গেছে, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরীর দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে এসব ‘অস্বাভাবিক’ আগাম জামিন ও আদেশ প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। পরে বিষয়টি আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়িয়েছে। এর পরই সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ফৌজদারি মোশন (জামিন আবেদনের শুনানির) এখতিয়ার বাতিল করেন প্রধান বিচারপতি। স্পর্শকাতর এ ধরনের মামলায় আসামিদের উচ্চ আদালতের দেওয়া এমন অস্বাভাবিক আইনি প্রতিকারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান। গত রোববার ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা’ শীর্ষক সেমিনারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের উপস্থিতিতে এই অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি তিনটি মামলার রেফারেন্স দেব। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে এসব মামলায় আদেশ দেওয়া হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের ঘটনায় সুনামগঞ্জের একটি মামলায় এজাহারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। হাইকোর্ট বিভাগের ওই বেঞ্চ উল্লেখ করলেন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় আসামিদের আগাম জামিন দেওয়া হলো। তারপর সেশন জজকে লিখে দিলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, এজন্য জামিন দিয়েছি। জেলা জজকে নির্দেশ দিলেন তুমি ওর জামিন বিবেচনা করবা। ওপরের এই পর্যবেক্ষণের আলোকে আমরা দেখছি এজাহারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও জামিন দেওয়া হয়েছে। আরেকটি মামলায় একই বেঞ্চ আসামিদের আট সপ্তাহের জামিন দিয়ে বগুড়ার জেলা জজকে অর্ডার করলেন। এমন অর্ডার করলেন যেখানে দুই বছর পর যদি বেইল বন্ড দাখিল করেন, তাহলে আসামিরা এই সময় পর্যন্ত ফ্রি-হ্যান্ডে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। একই বেঞ্চ আগাম জামিন আবেদন ৮-১০ সপ্তাহ মুলতবি করে এরপর জামিন আদেশ দিচ্ছেন। এই ৮-১০ সপ্তাহ পর শুনানি করবেন এবং এই সময়ের মধ্যে আসামিকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা যাবে না।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগে আর্থিক দুর্নীতির ব্যাপ্তি ক্যান্সারের মতো। কিন্তু এর চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে অ্যাটোমিক বোমার মতো। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের যেসব বিচারক বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, তারা বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছে, প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে, আমি তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুাখি করার পক্ষে মত দিচ্ছি। যদি বিচার বিভাগকে সঠিকপথে আনতে হয়, আর্থিক দুর্নীতির পাশাপাশি বৃদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিকে কবর দিতে হবে, যার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগে যেন আর কোনো খায়রুল হকের জন্ম না হয়। আর যেন গুম-খুনের রাজনীতি চালু না হয়।’
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার এমন স্পর্শকাতর বক্তব্যের পর আগাম জামিন দেওয়া ওই তিন মামলার ব্যাপারে কালবেলার পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানো হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ সদর থানায় গত বছরের ৮ অক্টোবর দায়ের করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলার এজাহারভুক্ত ২৭ নম্বর আসামি আনোয়ার হোসেনকে ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। গত ৪ মার্চ দেওয়া ওই জামিন আদেশে বলা হয়েছে, আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু মামলার এফআইআরে বলা হয়েছে, ২৭ নম্বর আসামির হাতে থাকা রড দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে জখম করে। এ ছাড়া এই মামলায় বেইল বন্ড দাখিল থেকে ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন দেওয়া হয়েছে আনোয়ারকে। আইনজীবীরা বলছেন, এই বেইল বন্ড যতদিন পরে দাখিল করবেন, ততদিন ওই আসামি এমনিতেই জামিনে থাকবেন। বেইল বন্ড দাখিল করার পর থেকে ৮ সপ্তাহ হিসাব হবে। এ ছাড়া হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে আসামির জামিন বিবেচনা করতে সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালতকে নির্দেশ দিয়েছেন। একইভাবে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর থানার একটি মামলার এজাহারভুক্ত ৬ জন আসামিকে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ গত ৩ মার্চ আগাম জামিন দিয়েছেন। এই ৬ আসামির বিরুদ্ধেও এজাহারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু জামিন আদেশে বলা হয়েছে, আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। এ ছাড়া এই মামলায়ও একই ধরনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এ ছাড়া বগুড়ার একটি মামলায়ও আগাম জামিনের ক্ষেত্রে একই ধরনের আদেশ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় মাগুরার মহম্মদপুর থানায় জাহিদুল ইসলাম ও জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৫ আগস্ট হত্যা মামলা হয়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩২৬/৩০২/৫০৬/১০৯/৩২৩ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন জাহিদুল ও জাকির। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জামিন আবেদনটি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের কার্যতালিকার ৪৫ নম্বর ক্রমিকে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওইদিন আংশিক শুনানি শেষে ২৮ মে পর্যন্ত তা মুলতবি করা হয়। এই মুলতবি সময় পর্যন্ত আসামিদের গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ল ইয়ার সার্টিফিকেট ইস্যু করেন আসামিদের আইনজীবী।
প্রসঙ্গত, ‘রাষ্ট্র বনাম জয়নুল আবেদীন ও অন্যান্য’ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আগাম জামিনে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। পুলিশ রিপোর্ট পর্যন্ত বিবাদীদের আগাম জামিন দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ আপিল বিভাগের রায়ের নীতি বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, মাঝেমধ্যে যথাযথ তদন্তের স্বার্থে কোনো মামলার প্রতিবেদন দিতে বেশি সময় নিতে পারে তদন্ত সংস্থা। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল না করা পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি আগাম জামিনের সুবিধা উপভোগ করার অধিকারী নয়। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় রমনা থানায় নাশকতার মামলা হয়। ওই মামলায় বিএনপির দুই আইনজীবী নেতা জয়নুল আবেদীন ও এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনকে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল পর্যন্ত আগাম জামিন দেন হাইকোর্ট। ওই আদেশের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগ শুনানি শেষে হাইকোর্টের আদেশ সংশোধন করে দেন। সংশোধনে আগাম জামিনের মেয়াদ পুলিশ রিপোর্ট দাখিল পর্যন্ত না রেখে আট সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়।
এর আগে ২০১৯ সালে নাশকতার মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ এক ডজন বিএনপি নেতার আগাম জামিনের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে আগাম জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে ১৬ দফা নীতিমালা অনুসরণের নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন তখনকার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। ওই রায়ে বলা হয়, হাইকোর্টকে মামলার এজাহার সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় নিতে হবে। আগাম জামিন দিলে আসামি পালিয়ে যাবে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আসামির চরিত্র, আচার-আচরণ বিবেচনায় নিতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির অপদস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, তা দেখতে হবে। আগাম জামিন পেয়ে আসামি যাতে সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখাতে না পারে, সেজন্য জামিনে শর্ত জুড়ে দিতে হবে। সর্বোপরি জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে আদালতকে। জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। হত্যা ও ধর্ষণে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে কেউ জামিন পাবে না। জামিন পাওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে হবে। আট সপ্তাহের বেশি আগাম জামিন নয়। এ ধরনের জামিনের অপব্যবহার করলেই তা বাতিল চাইতে পারবে রাষ্ট্রপক্ষ।
এদিকে, সম্প্রতি হাইকোর্টের আগাম জামিনের এমন নির্দেশনা আপিল বিভাগের রায়ের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি বলেন, আমাদের সাংবিধানিক বিধিমোতাবেক আপিল বিভাগের যে কোনো রায় এবং আদেশ হাইকোর্ট এবং অধস্তন আদালতের জন্য অনুসরণীয়। সেজন্য বিচারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে হাইকোর্ট বেঞ্চকে তার আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে এই সাংবিধানিক বিধান মেনে চলবেন। এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেটা না করায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিচারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে তিনি হয়তো এমন উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। আমি প্রত্যাশা করব, উচ্চ আদালত বিচারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার মাধ্যমেই পরিচালিত হবে।
মন্তব্য করুন