চলতি শিক্ষাবর্ষে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য কয়েক দফা মনোনয়ন তালিকা প্রকাশ করার পরও নির্ধারিত আসনে শিক্ষার্থী পাচ্ছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি বিভাগ। এগুলো হলো ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, উর্দু, সংস্কৃত এবং পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ। প্রতিষ্ঠানকালীন সময়ে এসব বিভাগের চাহিদা থাকলেও যুগের চাহিদা অনুযায়ী এসব বিভাগ অবদান না রাখতে পারায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ এসব বিভাগের শিক্ষকরা।
জানা গেছে, কলা অনুষদভুক্ত এই চার বিভাগে মোট আসন ২৭০টি। এর মধ্যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ৭৫টি, উর্দু বিভাগে ৭০টি, সংস্কৃত বিভাগে ৭৫টি এবং পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগে ৫০টি আসন রয়েছে। গত ২১ জুন থেকে কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে ভর্তির জন্য সাক্ষাৎকার শুরু হয়। পরে পাঁচবার ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার পরও এই চার বিভাগে ২৭০টি আসনের মধ্যে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন মাত্র ১৪১ জন। তার মধ্যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ৫১ জন, উর্দু বিভাগে ২৭ জন, সংস্কৃত বিভাগে ৩৭ জন এবং পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগে ২৬ জন।
ভর্তি নির্দেশিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, এই বিভাগগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ এক শর্ত জুড়ে দিয়েছে ঢাবি প্রশাসন। এই চার বিভাগসহ নির্দিষ্ট কয়েকটি বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মেধাক্রম অনুসারে প্রথম পর্যায়ের সাক্ষাৎকারভুক্ত প্রার্থীরা ব্যতীত অন্য প্রার্থীরা পরবর্তীকালে কোনো অবস্থাতেই বিভাগ পরিবর্তন করতে পারবে না। তার পরও খালি আসন পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। তবে, নির্ধারিত আসন পূরণ করতে পুনরায় সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির কালবেলাকে বলেন, সিট খালি থাকা সাপেক্ষে ভর্তির জন্য মোট পাঁচবার অনলাইনে মাইগ্রেশন হয়েছে। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা সবার আগে হয়েছে। ফলে এখানে ভর্তি না হয়ে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিতে যে বিষয়গুলো ভালো, তারা সেসব বিষয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ফলে আসনগুলো আপাতত ফাঁকা রয়েছে। তবে আমরা মাইগ্রেশন চালু করেছি এবং দ্রুতই সেগুলো পূরণ হয়ে যাবে। ওই বিষয়গুলোতে আরও কিছু আসন কমানো উচিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিট কমানো বা বাড়ানোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকদের কাজ।
জানা গেছে, শতবর্ষ পূরণ করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নানা কারণে হতাশ। আর হতাশায় তুলনামূলক এগিয়ে এই চার বিভাগের শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা জানায়, এ বিষয়গুলোর ব্যবহারিক চাহিদা তুলনামূলক কমে গেছে। বিশ্বের নামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভাষাভিত্তিক বিষয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এ দেশে তেমন সুযোগ সুবিধা নেই। এমনকি এসব বিষয়ের আলাদা তেমন কোনো চাকরির ক্ষেত্রও নেই।
ঢাবির ফারসি ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মিতু আক্তার। বিভাগের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন তিনি। অথচ নিজ বিভাগে পড়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। এ বিষয়ে তিনি কালবেলাকে বলেন, যখন ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তখন এ বিশ্ববিদ্যালয় আমার জন্য আবেগ ছিল। কিন্তু এখন দেখি, চাকরির বাজারে এই বিভাগের কোনো মূল্য নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় ছাড়া এই বিভাগ থেকে কিছুই নিয়ে যাচ্ছি না। আমার সাবজেক্ট সংশ্লিষ্ট দেশ ইরান।
শুধু যুগের চাহিদার তুলনায় পিছিয়ে থাকা নয়, প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও এসব বিভাগের শিক্ষার মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। ২০২১ সালের ঢাবির সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেতে চাকরিপ্রত্যাশী ১১ জন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে প্রার্থীরা সংস্কৃত পড়তে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খান। অথচ নিয়োগ পেলে শিক্ষার্থীদের এই ভাষাই শেখানোর কথা ছিল। এসব বিভাগে বাংলা ভার্সনে শিক্ষার্থী পড়ানো হয়। তুলনামূলক চাকরির বাজারে বিভাগের মূল্য কম থাকায় অনেক বিভাগে ভর্তির পর শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের অন্যত্র চলে যেতে বলেন।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান কালবেলাকে বলেন, ভর্তির বিষয়ে এবারের মতো কখনো হয়নি। হয়তো ভর্তি প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো সমস্যা রয়েছে। এ বছর আমরা ২৫ জন শিক্ষার্থী কমিয়েছি। ৭৫ জন শিক্ষাথীকে ভর্তি করতে অন্তত ৫০০ শিক্ষার্থী সিরিয়ালে থাকে। এবার ভর্তি প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও সমস্যা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল কালবেলাকে বলেন, এগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক সাবজেক্ট। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এই সাবজেক্টগুলো রয়েছে।
ঢাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ কালবেলাকে বলেন, এই বিভাগগুলোতে বাংলা ভাষায় শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। আমি নিজে এই বিভাগ নিয়ে লেখালেখি করেছি। ভাষার নামে যে বিভাগগুলো রয়েছে এগুলোতে ভাষা বিষয়ে ছেলেমেয়েদের দক্ষতা দরকার। এই বিভাগগুলোতে ছাত্র সংখ্যা কমিয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা আধুনিক ও নতুন বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে পারে, ভাষায় সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম পায়। এই বিভাগগুলোর মধ্যে সংস্কার আনতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
মন্তব্য করুন