বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর দেওয়া বক্তব্যকে ‘আপত্তিকর’ ও ‘কুরুচিপূর্ণ’ উল্লেখ করে এর প্রতিবাদে কক্সবাজারের থানায় থানায় বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। গতকাল শনিবার বিকেলে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর দেওয়া বক্তব্যের জেরে কক্সবাজার সদরসহ জেলার একাধিক জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ সময় চকরিয়ায় এনসিপির পথসভায় স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা বাধা দিয়ে ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ ভাঙচুর করেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বক্তব্যের জেরে এনসিপির জুলাই পদযাত্রা বান্দরবান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের ঈদগাহ, চকরিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়ার পূর্বনির্ধারিত পথসভা পণ্ড হয়ে যায়। এ সময় আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বহনকারী গাড়িবহর নিরাপত্তা শঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কক্সবাজারের চকরিয়ার হাঁসের দিঘী আর্মি ক্যাম্প এলাকায় দুই ঘণ্টা থামিয়ে রাখে। পরে বিকেল সাড়ে ৫টায় সেনাসদস্যদের কড়া নিরাপত্তা কর্ডনে চকরিয়া এলাকা পার হয় জুলাই পদযাত্রার গাড়িবহর।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে ‘নব্য গডফাদার’ আখ্যায়িত করে বক্তব্য দেওয়ার পর দলটির নেতাকর্মীদের বিক্ষোভের মুখে ঈদগাহ ও চকরিয়া উপজেলায় সমাবেশ করতে পারেনি এনসিপি। চকরিয়ায় পথসভা করার জন্য একটি ট্রাকে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, সেটি ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া সেই স্থানের আশপাশের রাস্তায় ডিভাইডার ভাঙচুর করতে দেখা গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরই মধ্যে এনসিপি নেতাকর্মীরা গাড়িবহর নিয়ে কক্সবাজার থেকে বান্দরবানের পথে রওনা হন।
এর আগে জুলাই পদযাত্রার ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল কক্সবাজারে সমাবেশ করেন এনসিপি নেতাকর্মীরা। দুপুরে কক্সবাজারের শহীদ দৌলত ময়দানের সমাবেশে এনসিপির মুখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে ইঙ্গিত করে ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য দেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী কক্সবাজারের সমাবেশে বলেন, ‘আগে নারায়ণগঞ্জে বিখ্যাত গডফাদার শামীম ওসমান ছিল। এখন শুনছি কক্সবাজারের নব্য গডফাদার শিলং থেকে এসেছে। ঘের দখল করছে, মানুষের জায়গাজমি দখল করছে। চাঁদাবাজি দখল করছে। আবার নাকি সে সংস্কার বোঝে না। নাম না বললাম। কক্সবাজারের জনতা এ ধরনের সংস্কারবিরোধী যে পিআর বোঝে না, রাজপথে তাদের দেখিয়ে দিবে ইনশাআল্লাহ।’ এরপরই তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চকরিয়ায় দুপুর থেকে এনসিপির পক্ষে মঞ্চ তৈরি করে মাইকিং করা হচ্ছিল। হঠাৎ বিকেল পৌনে ৪টার দিকে কিছু লোক লাঠিসোটা নিয়ে মঞ্চে হামলা করেন। এনসিপির মাইকিং করা লোকজনকে তাড়িয়ে দেন তারা।
এনসিপির নেতাকর্মীরা জানান, বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মীরা চকরিয়া জনতা শপিং সেন্টার চত্বরে বানানো ট্রাকে মঞ্চটি ভেঙে ফেলেন। এ সময় তারা সমাবেশের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন ও ট্রাকের কাচ ভাঙচুর করেন। তাৎক্ষণিক সেনাবাহিনী সমাবেশস্থলে পৌঁছে হামলাকারীদের ধাওয়া দেয়।
চকরিয়া থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, এ ঘটনার পর সংঘর্ষ এড়াতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকে।
এনসিপির চকরিয়া উপজেলা সংগঠক খাইরুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে সমাবেশের মঞ্চ ভাঙচুর করেছেন। ব্যানার ছিঁড়ে ও ট্রাকের কাচ ভাঙচুর করেছেন। পরে বিএনপির নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থল দখল করে নিয়ে স্লোগান দেন।’
চকরিয়ার ঘটনার পর এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ইমন সৈয়দ মোবাইল ফোনে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চকরিয়ায় আমাদের সমাবেশ ছিল। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা মঞ্চ ভাঙচুর করেছেন। এ কারণে সেখানে অনুষ্ঠান হয়নি। আমাদের নেতাকর্মীরা চকরিয়ায় অবস্থান করেননি। আমরা বর্তমানে (বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে) লামা-থানচি সড়কের ফাসিয়াখালী এলাকায় অবস্থান করছি। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরাও সঙ্গে আছেন। এখানে বিএনপির নেতাকর্মীদের একটা জটলা রয়েছে। আমরা আতঙ্কিত অবস্থায় আছি।’
কক্সবাজারের সমাবেশে দেওয়া নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বক্তব্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গেই জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু করেন বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। দুপুর আড়াইটার দিকে সমাবেশ শেষ করে কক্সবাজার ছাড়ে এনসিপির গাড়িবহর। যাত্রাপথে সমাবেশ করার কথা ছিল ঈদগাঁও উপজেলায়। সেখানে বিএনপির তোপের মুখে সমাবেশ না করেই চলে যান এনসিপি নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে চকরিয়ায় এনসিপির সমাবেশস্থলে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
ýচকরিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এনামুল হক বলেন, ‘বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ একজন জাতীয় নেতা। তাকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করা খুব দুঃখজনক। এনসিপির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে যে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, তা প্রত্যাহার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
এরপর কক্সবাজারেও বিক্ষোভে নামেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা এনসিপির সমাবেশ ঘিরে লাগানো ব্যানার-ফেস্টুন ছিঁড়ে সড়কে আগুন দেন। পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল সড়ক প্রদক্ষিণ করে সমাবেশ করে।
এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ ও হামলার পর এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি লেখেন, ‘কক্সবাজারের চকরিয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গাড়িবহর আটকে রেখেছেন।’
হান্নান মাসউদ বলেন, ‘চকরিয়াতে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির গাড়িবহর আটকে রেখেছেন বিএনপির লোকজন। তারা গাড়িবহর আটকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের নামে স্লোগান দিচ্ছেন। লোহাগাড়ায় ব্যানার-ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলেছেন।’
ফেসবুক পোস্টে তিনি আরও বলেন, ‘যেমন লীগ ১৬ বছর ধরে করছে, ঠিক তেমনি আপনারাও করছেন। তাদের পরিণতি দেখে যদি শিক্ষা না নিতে পারেন, তাহলে সেইম পরিণতির জন্য আপনারাও অপেক্ষা করুন।’
নতুন করে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে অভিযোগ নাহিদের: গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে নতুন করে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। বিএনপি নেতাকর্মীদের বিক্ষোভের মুখে কক্সবাজারের চার থানায় এনসিপির পথসভা পণ্ড এবং জেলার চকরিয়ায় পথসভার মঞ্চ ভাঙচুরের পর রাতে বান্দরবানের কর্মসূচিতে এ কথা বলেন তিনি। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘চকরিয়ায় আমাদের ওপর হামলার চেষ্টা করা হয়েছে এবং বাধা দেওয়া হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে নতুন করে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে। আমরা বলেছিলাম একটি সম্প্রীতি এবং সংহতির বাংলাদেশ গড়ে তুলব। মতপ্রকাশের অধিকার থাকে, তাহলে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে গেলেও সেটি গণতান্ত্রিকভাবে প্রকাশ করবেন। কিন্তু আমরা দেখেছি অগণতান্ত্রিকভাবে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সামনে যদি কেউ ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতে চায়, জনগণ আবারও রাজপথে নামবে।’ রাত পৌনে ৯টার দিকে বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সামনে বান্দরবান এনসিপি আয়োজিত পথসভার মঞ্চে এসব কথা বলেন দলটির আহ্বায়ক।
এ সময় অন্যদের মধ্যে দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি, স্থানীয় জেলা সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী মো. শহীদুর রহমান সোহেল প্রমুখ বক্তব্য দেন।
এর আগে রাত ৮টা ২২ মিনিটে কক্সবাজার থেকে সড়কপথে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা বান্দরবান সদরে পৌঁছান। পরে বাসস্টেশন থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা পদযাত্রা করে প্রধান সড়ক ধরে ট্রাফিক মোড়ের সোনালী ব্যাংকের সামনে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন বান্দরবান, কক্সবাজার, পেকুয়া (কক্সবাজার) ও ঈদগাঁও (কক্সবাজার) প্রতিনিধি।
মন্তব্য করুন