চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে গতকাল রোববার দুপুর পর্যন্ত স্থানীয়দের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে এ সংঘর্ষ চলে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশে জোবরা গ্রাম রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ ঘটনায় চবির উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ দুই শতাধিক আহত হয়েছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গতকাল বিকেলে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। মোতায়েন করা হয় যৌথ বাহিনী। এরপর বিকেল থেকেই হাসপাতালে ভিড় বাড়ে আহতদের। কেউ মেঝেতে, কাউকে কাতরাতে দেখা যায় বেডে। কারও বুকে, কারও মাথা কিংবা শরীরজুড়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা স্থানীয়দের সঙ্গে মিলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে: শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটের কাছে এক ছাত্রী একটি ভবনে ভাড়া থাকেন। শনিবার রাত ১২টার দিকে তিনি ওই ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করলে দারোয়ানের সঙ্গে তার তর্ক হয়। একপর্যায়ে ভবনের দারোয়ান ছাত্রীকে মারধর করেন। এ সময় ২ নম্বর গেটে থাকা শিক্ষার্থীরা দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে শিক্ষার্থীরা তাকে ধাওয়া করলে স্থানীয় লোকজন শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। তখন সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর স্থানীয় লোকজন মাইকে ডেকে লোক জড়ো করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। সংঘর্ষে দুইশ’র বেশি শিক্ষার্থী আহত হন। পরে রাত সাড়ে ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় স্থানীয়রা প্রক্টর ও পুলিশের তিনটি যানবাহনে ভাঙচুর চালান।
তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা হামলা চালিয়েছেন। ভাঙচুর করা হয়েছে ঘরবাড়ি। ওই ঘটনার জেরে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এক প্রান্তে কয়েকশ শিক্ষার্থী অবস্থান নেন। বিপরীত দিকে ছিলেন এলাকাবাসী। দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় দুই উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শিক্ষকরা দুই পক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে দুপুর ১২টা ৫ মিনিটের দিকে ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেট-সংলগ্ন জোবরা গ্রামে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়, যা চলে প্রায় বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত। এ সময় স্থানীয়রা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকেন। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
উপ-উপাচার্যের কান্না: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ধরনের সহায়তা না পাওয়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েন আহত উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন। বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমি কমপারেটিভলি ভালো আছি। আমার ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি আহত। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সাহায্য পাইনি। প্রত্যেক ছাত্রকে তারা দা দিয়ে কোপাচ্ছে। এটা কোন জগতে আছি আমরা! আপনারা আমাদের ছাত্রদের উদ্ধার করুন। আমাদের প্রক্টর, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) আহত, আমাদের প্রায় সব শিক্ষক-ছাত্র আহত। আমরা মেডিকেলে জায়গা দিতে পারছি না। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা হেলমেট পরে আমাদের ছাত্রদের মারতেছে। আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে কথা বলেছি, কিন্তু এখনো আমাদের পাশে কেউ নেই।’
চমেকের মেঝেতে পড়ে আছেন কেউ, কেউ বেডে কাতরাচ্ছেন: আহতদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে গুরুতর আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুপুরে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, কেউ মেঝেতে পড়ে আছেন, কেউ বেডে শুয়ে আছেন। তারা স্থানীয়দের ছোড়া ইটপাটকেল ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। কারও হাত ভেঙেছে, কারও পা ভেঙেছে। কেউ অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন।
চমেকের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা গুরুতর। এরপর আরও কয়েকজন চিকিৎসা নিতে আসেন। এর আগে শনিবার রাতে আসেন ২৭ জন।
জরুরি বিভাগে কর্মরত একজন মেডিকেল অফিসার কালবেলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত আনুমানিক ৪০ জন চিকিৎসা নিতে এসেছেন। আমরা এখনো হিসাব করিনি। আঘাতের ধরন দেখে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এদিকে সন্ধ্যায় চমেক হাসপাতাল পরিদর্শনে যান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্রতিটি ওয়ার্ডেই আহত শিক্ষার্থীদের কুইক চিকিৎসা চলছে। যাকে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে চিকিৎসা দিচ্ছেন।’
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় কালবেলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৪০ থেকে ৪৫ জন শিক্ষার্থী এসেছে। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক কেউ নেই। আহতদের মধ্যে ১১ জন ২৮নং ও ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দীন খান কালবেলাকে বলেন, ‘স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বসেছি। পরিস্থিতি এখন কিছুটা শান্ত আছে। বৈঠকে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’
‘দেড় ঘণ্টা ধরে পিটিয়েছে, মৃত ভেবে ফেলে গেছে একবার’: মারধরে আহত রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রক্টর স্যার আক্রান্ত হয়েছে শুনে আমরা ওনাকে উদ্ধার করতে যাই। গ্রামবাসী প্রক্টর স্যারসহ ১০-১৫ জনকে মারধর করতে থাকে। আমরা একপর্যায়ে নিজেদের বাঁচাতে দৌড় দিই। আমরা দুজন দৌড়ে গ্রামের কয়েকটা বাড়ির দিকে গেলে গ্রামবাসী চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরে। দেড় ঘণ্টা ধরে চলে তাদের মারধর। এর মধ্যে দুবার অজ্ঞান হয়ে যাই। প্রথমবার অজ্ঞান হওয়ার পর মৃত ভেবে তারা ফেলে যায়। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে আবার মারা শুরু করে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। আমরা দৌড়ে ক্ষেতের মধ্যে পালাতে চাইলে সেখানেও মারে। মারধরের একপর্যায়ে তারা মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। তাদের পায়ে ধরে মোবাইল ফোন উদ্ধার করি।’
ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আটকে থাকা শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গেলে স্থানীয়রা এলোপাতাড়ি ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। তাদের ছোড়া ইটের আঘাতে আমার মাথা ফেটে যায়। কয়েকটা সেলাই করতে হয়েছে।’
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রক্টরদের গাড়ি এখানে উপস্থিত হওয়ার পর আমরা এগিয়ে আসি। কিন্তু এ সময় মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা আসে ‘জোবরাবাসী এক হও, বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালাইছে।’ এ সময় বাছা মিয়ার দোকানের ওখানে প্রাইমারি স্কুলের পাশ থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মীরা আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা নিজেরাও জোবরার মানুষ। তারা আহত শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্যও এগিয়ে আসেনি।’
ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন: গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের হামলার বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে শাখা ছাত্রদল। এ সময় সংঘর্ষে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
১৪৪ ধারা জারি, থমথমে ক্যাম্পাস: সংঘর্ষের জেরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। আজ সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত এ ধারা বলবৎ থাকবে। গতকাল বিকেল ৩টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘হাটহাজারী উপজেলাধীন ফতেপুর ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট বাজারের পূর্ব দিক থেকে রেলগেট পর্যন্ত উভয় দিকের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। এ ছাড়া ২ নম্বর গেট এলাকায় সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ, গণজমায়েত কিংবা অস্ত্র পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উল্লিখিত এলাকায় ৫ জনের বেশি ব্যক্তি একসঙ্গে চলাচল করতে পারবেন না।’
যৌথ বাহিনী মোতায়েন: দফায় দফায় সংঘর্ষ শেষে বিকেল ৪টার দিকে ক্যাম্পাসে অভিযানে নেমেছে যৌথ বাহিনী। এ সময় ক্যাম্পাসের আশপাশে যৌথ বাহিনীর অন্তত ১০টি গাড়ি প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এর আগে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত টানা সংঘর্ষ চললেও এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি।
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘উসকানির’ অভিযোগ, বিএনপি নেতাকে বহিষ্কার: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জোবরা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের সংঘর্ষের ঘটনায় ‘উসকানি’ ও শিক্ষার্থীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়ার অভিযোগে বিএনপি নেতা উদয় কুসুম বড়ুয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। উদয় কুসুম বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তার বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন ২ নম্বর গেট এলাকায়। গতকাল বিকেলে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মন্তব্য করুন