শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২
কালবেলা প্রতিবেদক, ঢাকা এবং
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ বেশি গাইবান্ধা ও রংপুরে

উত্তরে আতঙ্ক
অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ বেশি গাইবান্ধা ও রংপুরে

রংপুর ও গাইবান্ধা প্রতিনিধি

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে কিশামত সদর গ্রাম। সুন্দরগঞ্জ-হরিপুর পাকা সড়ক থেকে কাঁচা ও বিধ্বস্ত প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পর কিশামত সদর গ্রাম। এ গ্রামের অনেকের শরীরেই অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ। কেউ চোখ ফোলা নিয়ে, কেউ হাতে ফোসকা নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাদের কারও এক হাতে, কারও দুই হাতেই ফোসকা পড়েছে। এর মধ্যে মোজাফফর আলীর বাঁ-চোখ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম ও লোকমুখে শুনে অনেকেই আসছেন পরিস্থিতি দেখতে। ওই জনপদে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে এক নারীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গত দুদিনে আরও ছয় ব্যক্তির শরীরে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ২২ জনের মধ্যে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ পাওয়ার পর আতঙ্ক বিরাজ করছে। অবশ্য স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ওই নারী অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যাননি।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তারা হলেন— মধ্যে বেলকা গ্রামের সামিউল ইসলাম, সাহাদৎ হোসেন, সবুজ মিয়া, বেলকা নবাবগঞ্জ গ্রামের আজিজল হক, পশ্চিম বেলকা গ্রামের ভূট্ট মিয়া, আতিকুর রহমান, শহিদুল ইসলাম, বেলকা গ্রামের মোজাহার আলী, মোজাফফর হোসেন, খতিব মিয়া, ফরিদুল হক, রুজিনা বেগম, কিশামত সদর গ্রামের মোজা মিয়া, মাহবুর রহমান, শাফিকুল ইসলাম, স্বাধীন মিয়া, সকিনা বেগম, তাইজল মিয়া, শিশু ছায়ফান, আফরিন বেগম, ছালদিয়া ইসলাম, ও রইসুল মিয়া। এদের মধ্যে রুজিনা বেগম, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান।

একই পরিস্থিতি রংপুরের বিভিন্ন উপজেলায়। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, রংপুরের পীরগাছা থেকে ১২টি, কাউনিয়া থেকে ৪টি ও মিঠাপুকুর থেকে ৫ টিসহ ২১টি নমুনা বিভিন্ন মানুষের শরীর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তার মধ্যে ১১টিতেই অ্যানথ্রাক্স পজিটিভ ধরা পড়েছে। গত চার দশকে অ্যানথ্রাক্স অন্তত ১৬ জেলায় শনাক্ত হয়েছে। রোগটি নিয়ে উত্তরের জনপদে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। কমে গেছে, গরু-ছাগলের মাংস বেচাকেনাও। গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে কৃষকরা। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা, জনসচেতনতা নিয়ে পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকাদান ও সংক্রমণ প্রবণ এলাকায় জনসচেতনতার মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব। রোগটি প্রাণী থেকে প্রাণী বা মানুষ থেকে মানুষে সহজে সংক্রমিত হয় না। সংক্রমণ ঘটে তখনই, যখন জীবাণুর স্পোর বা বীজ মুখ, শ্বাসনালি বা ত্বকের ক্ষত দিয়ে দেহে প্রবেশ করে।

তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে গবাদিপশু এবং মানুষের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। রোগটি প্রথম শনাক্ত হয় পাবনায়। পরে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী ও চট্টগ্রামে সংক্রমণ দেখা গেছে। আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের শরীরে অ্যানথ্রাক্স মূলত তিন ধরনের হয়। ত্বকের, পাচনতন্ত্রের, শ্বাসনালির অ্যানথ্রাক্স। ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে সাধারণ। প্রায় ৯৫ শতাংশ সংক্রমণই এ ধরনের। যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এতে মৃত্যুর আশঙ্কা কম। পাচনতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ ঘটে আক্রান্ত পশুর মাংস খাওয়ার মাধ্যমে। এতে মৃত্যুর হার ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের সংক্রমণের ঘটনা শনাক্ত হয়নি। শ্বাসনালির অ্যানথ্রাক্স অত্যন্ত বিরল ও মারাত্মক। প্রাথমিকভাবে এর উপসর্গ সর্দিজ্বরের মতো। সাময়িক স্বস্তির পর রোগী দ্রুত জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও শকে আক্রান্ত হয়। প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া না হলে মৃত্যুর হার প্রায় ৯৫ শতাংশ।

সরেজমিন গাইবান্ধার কিশামত সদর গ্রামের অনেকের শরীরেই অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেয়। কিশামত সদর গ্রামের হাসান মিয়া বলেন, এ ঘটনার পর থেকে গ্রামে মাংস বিক্রি হচ্ছে না। গরু-ছাগল জবাই কম হচ্ছে। কেউ কেউ জবাই করছেন; কিন্তু জবাই করার আগে প্রশাসন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে না। একই গ্রামের গনি মিয়া (৬০) বলেন, গরু-ছাগলকে অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা দেওয়ার বিনিময়ে ১০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। কারও কাছে বেশিও নেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার দে বলেন, গরু-ছাগলকে অ্যানথ্রাক্স রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। সচেতনতায় উঠান বৈঠক, মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি চারটি গরুর নমুনা পরীক্ষা করে দুটির মধ্যে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। ৬টি মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক মাঠে কাজ করছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ আগস্ট থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ১৩টি গরু মারা যায়। ঢাকা থেকে প্রতিটি অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা ৮০ পয়সা করে কিনে আনতে হয়েছে। তাই টিকা প্রদানের সময় অন্য খরচসহ ৫ টাকার মধ্যে নিতে বলা হয়েছে।

আক্রান্ত মোজাফফর আলী (৫০) বলেন, গত ২৭ সেপ্টেম্বর গরু কাটায় অংশ নিয়েছিলেন। এর দুদিন পর বাঁ-হাতে ও বাঁ-চোখে ফোসকা দেখা দেয়। এরপর সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। সেখানে ভর্তি হতে চাইলে, চিকিৎসক ওষুধ লিখে দিয়ে বিদায় করে দেন। বাড়িতে ফিরে ওষুধ খেয়ে দুদিন অপেক্ষা করেন; কিন্তু ফোসকা ভালো হয় না। পরে গত শুক্রবার রংপুর থেকে গাইবান্ধার রাবেয়া ক্লিনিকে আসা একজন চর্মরোগবিশেষজ্ঞের কাছে যাই। তিনি চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেন। তার লেখা ওষুধ খাচ্ছেন। একটু আরোগ্য হয়েছে। তবে বাহিরে চলাফেরা করতে গেলে মানুষ দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় এবং বাড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

গরু কাটায় অংশ নেওয়া একই গ্রামের নুরুন্নবী মিয়ার (১৬) মা নুরনাহার বেগম (৫৬) বলেন, ‘আমার ছেলের ডান হাতে ফোসকা পড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি করতে চেয়েছিলাম। চিকিৎসকরা ভর্তি নেননি। ভাইরাস আছে বলে চিকিৎসক দূরে থেকে আমার ছেলের ওষুধ লিখে দেন। পরে গাইবান্ধার রাবেয়া ক্লিনিকে গিয়ে চর্মরোগবিশেষজ্ঞের পরামর্শে চিকিৎসা চলছে। ছেলে অনেকটা ভালোর দিকে।’ তবে ওষুধের দাম অনেক বেশি। ২০ দিনের ওষুধ কিনতে প্রায় ৩ হাজার টাকা দরকার। সরকারিভাবে ওষুধ সরবরাহ করলে সুবিধা হয়।

এসব বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিবাকর বসাক কালবেলাকে বলেন, অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে মারাত্মকভাবে কেউ আক্রান্ত ছিলেন না। তাই ভর্তি রাখার প্রয়োজন হয়নি। তিনি বলেন, বেশিরভাগ রোগী অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে রাতে হাসপাতালে এসেছিলেন। সে কারণে তাদের ওষুধ দেওয়া সম্ভাব হয়নি। গত দুদিনে (সোমবার ও মঙ্গলবার) নতুন করে আরও ৬ জন চিকিৎসা নিয়ে গেছেন। এ নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৬ জনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। রোগীদের ১০ দিনের অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেওয়া হচ্ছে। অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে ১৫ হতে ২০ দিনের মধ্যে সুস্থ হওয়ার কথা। উপজেলায় একটি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন মো. রফিকুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, অ্যানথ্রাক্স শুধু চামড়ায় উপসর্গ হয়। এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এ রোগ কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। আমরা অ্যানথ্রাক্স রোগ প্রতিরোধে এরই মধ্যে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য সচেতনতামূলক কাজ করছি। এ ছাড়া একটি মেডিকেল টিমও গঠন করা হয়েছে, তারা মাঠে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত সুন্দরগঞ্জ উপজেলা ব্যতীত অন্য কোনো উপজেলায় এ রোগ ছড়ায়নি।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা ইউনিয়নের কিশামত সদর গ্রামে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত একটি গরু জবাই করা হয়। এতে ওই গ্রামের ১১ জন অংশ নেন। দুদিন পর তাদের শরীরে বিভিন্ন অংশে ফোসকা পড়ে এবং মাংসে পচন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। বিশেষ করে হাত, নাক, মুখ, চোখে এসব উপসর্গ দেখা যায়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মা-বাবাকে হত্যা করে ঘরে পুঁতে রাখল জুয়ায় আসক্ত ছেলে

বৃহত্তর মিরপুরে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত

দেশ বাঁচাতে হলে বিএনপির বিকল্প নেই : টুকু

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা / বস্তিবাসী ও শহীদ পরিবারের ন্যায্য দাবি মেনে নিন

মা-মেয়েকে গলা কেটে হত্যা

রাজধানীতে ১৭ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জাগপা ছাত্রলীগের বৈঠক

হাত-মুখ বেঁধে শিশুকে ধর্ষণ, যুবককে খুঁজছে পুলিশ

এনসিটিবির নামে ‘নকল’ ছাপাখানা, আটক ৫ 

পচা চাল ক্রয়, বাচ্চু মিয়াকে বাধ্যতামূলক অবসর

শহিদুল আলমসহ নৌবহর থেকে আটক ব্যক্তিদের কারাগারে বন্দি

১০

পা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন আইসক্রিম বিক্রেতা রফিকুল

১১

গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা তারেক রহমানের অঙ্গীকার : সাঈদ

১২

চাকসু নির্বাচনের প্রচারে এগিয়ে ছাত্রদলের প্যানেল

১৩

জনপ্রশাসনের এপিডি এরফানুল হককে বদলি

১৪

কর্ণফুলীর তীরে নতুন আশা

১৫

চাকসু নির্বাচনে আরও তিন প্যানেলের ইশতেহার ঘোষণা

১৬

সিলেট বিমানবন্দরে বিদ্যুৎস্পর্শে যুবকের মৃত্যু, থানায় মামলা

১৭

বৃষ্টি আর কতদিন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

১৮

আগে টাইফয়েড টিকা গ্রহণকারীরা কি আবার নিতে পারবে?

১৯

বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামছেন সাবেক মেয়র আরিফ

২০
X