দেশের রাজনীতি এখন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বহু প্রতীক্ষিত এবং জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নিয়ে দেশ-জাতির অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। দীর্ঘ আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর আজ শুক্রবার বিকেল ৪টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে জুলাই সনদ।
ঐকমত্য কমিশন ও দলগুলোর বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, শেষ মুহূর্তে এসেও জুলাই সনদ নিয়ে সংকট যেন কাটছে না। সনদে স্বাক্ষর করা না করা নিয়ে দলগুলো এখনো বিভক্ত। সনদে স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করায় জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না সিপিবিসহ চার দল। এ ছাড়া শর্ত দিয়েছে গণফোরাম এবং এনসিপি। এরমধ্যে এনসিপি, সিপিবিসহ ৫টি দল আজকের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাচ্ছে না। অবশ্য বিএনপি জুলাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামীর দায়িত্বশীল নেতারা গতকাল রাতে বৈঠক করেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে দলটির প্রতিনিধিরা যাবেন। তবে পরিস্থিতি বুঝে তারা সনদে স্বাক্ষর করবেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ সনদটিকে জাতীয় সংকট নিরসন, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নির্ধারণের এক ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে দেখা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ ঐতিহাসিক দলিলে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর করা না করা নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা ও বিভক্তি, যা জাতিকে এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে পারে।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জাতীয় জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সাংবাদিক মনির হায়দার গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে দাওয়াত পৌঁছে দেন।
বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্যেই বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘অতীব জরুরি’ বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেদিন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদ ও আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে আশার কথা শোনালেও রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ দূর হয়নি বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। ওই বৈঠকে অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি (রব), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
অবশ্য বুধবারের বৈঠকে সমাপনী বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দীর্ঘ প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সবাইকে একটি জায়গায় এনেছে। আপনারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। যা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য নজির। জাতি অভিভূত হয়েছে। কারও কারও জুলাই সনদ নিয়ে সন্দেহ ছিল। তবে এ ঘটনা দেশের মানুষ চিরদিন স্মরণ করবে। আমি নিজেও গর্ববোধ করছি। এ ঘটনা ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তিনি সবাইকে অগ্রিম প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, জুলাই সনদ স্বাক্ষরের বিষয়টি গোটা জাতি উপভোগ করবে। যেই কলম দিয়ে সনদে স্বাক্ষর করা হবে, সেগুলো সংরক্ষণ করা হবে। জুলাই সনদ জাতির জন্য মস্তবড়ো সম্পদ। যে দলিল আপনারা তৈরি করেছেন, তা হারিয়ে যাবে না। এটি সবার কাছে যাবে। যাতে তারা বোঝে যে, আমরা কেন একমত হলাম? জুলাই সনদে স্বাক্ষর মানেই সব শেষ, তা নয়। এটির বিস্তার করতে হবে। সনদের পরবর্তী কাজ যেন অব্যাহত থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তৈরি হওয়া জটিলতা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে। মূল সমস্যাটি হলো, সনদের কিছু বিষয়ে দলগুলো নিজ নিজ যুক্তিতে অনড়। এক পক্ষ বলছে, সনদে মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্য পক্ষের অভিযোগ, এ সনদ অতীত রাজনৈতিক দায়মুক্তির পথ তৈরি করতে পারে। সনদের আইনি ভিত্তি এবং এর প্রয়োগ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। এ টানাপোড়েনের ফলে সমঝোতার টেবিল থেকে বারবার উঠে যেতে বাধ্য হচ্ছে শীর্ষ নেতৃত্ব। এ জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আরোপিত বিভিন্ন শর্ত। প্রতিটি দলই সনদে স্বাক্ষর করার আগে তাদের নিজস্ব কিছু দাবি বা পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দিচ্ছে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাচ্ছে না ৫টি দল: আজ জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাচ্ছে না ৫টি দল। জুলাই জাতীয় সনদের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে সংশোধিত খসড়া না পেলে সনদে সই করবে না বাম ধারার চারটি দল। দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ। গতকাল বিকেলে রাজধানীর পুরানা পল্টনে সিপিবির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছে দলগুলো। এ ছাড়া এনসিপি বলছে, শর্ত না মানলে তারা সনদের স্বাক্ষর করবে না। জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে তাতে সংশোধনের দাবি জানিয়েছে দলগুলো।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ঐকমত্য কমিশনের যাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সব দল যেসব বিষয়ে একমত হবে—শুধু সেগুলোই ঐকমত্য হিসেবে বিবেচিত হবে। আমরাও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলাম এবং ঐকমত্য কমিশনের সব সভায় উপস্থিত থেকে আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি। কিন্তু জুলাই সনদের যে চূড়ান্ত কপি গত ১৪ অক্টোবর আমাদের কাছে পাঠিয়েছে, সেখানে দেখলাম সর্বসম্মত বিষয় ছাড়াও নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দেওয়া প্রস্তাবগুলো সনদে যুক্ত করেছে। আমাদের দেওয়া নোট অব ডিসেন্টগুলোর কারণও যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি।
জুলাই সনদে সই না করার কারণ হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জুলাই সনদের প্রথম অংশের পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি, বারবার সংশোধনী দিলেও সেগুলো সন্নিবেশিত করা হয়নি। সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ৬ষ্ঠ তপশিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ এবং ৭ম তপশিলে থাকা ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, তা বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। অথচ জুলাই সনদ সংবিধানের তপশিলে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে; পটভূমিতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার কথা আগে পাঠানো খসড়া সনদে উল্লেখ থাকলেও চূড়ান্ত সনদে ১০৬ অনুচ্ছেদের কথা বাদ দেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় তাদের পক্ষে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান বজলুর রশীদ ফিরোজ। তিনি বলেন, ‘সংবিধানে বিদ্যমান চার মূলনীতি—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এবং ১৫০(২) অনুচ্ছেদের ক্রান্তিকালীন বিধানের তপশিল পরিবর্তনে সম্মতি প্রদান ও আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না—এমন বিষয়ে অঙ্গীকার করতে হয়, এমন কোনো সনদে ভিন্নমত দিয়ে আমরা স্বাক্ষর করতে পারি না। তা ছাড়া জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামার ৩ নম্বর-এ ‘জুলাই সনদ নিয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না, বলে যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে—এটি নাগরিকের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থি বলে মনে করে দলগুলো।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, বাসদের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিবির সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ।
এদিকে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গতকাল কালবেলাকে বলেন, তারা যে তিনটি দাবি জানিয়েছেন, সেগুলোর বিষয়েই তারা অনড় আছেন। তবে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাওয়া এবং স্বাক্ষর করার বিষয়ে তাদের নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান গতকাল কালবেলাকে বলেন, তারা জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবেন। তবে আমাদের একটি বিষয়ে অবজারভেশন আছে। সেটি না মানলে আমরা সনদের স্বাক্ষর করব না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, পিআর না হলে সনদে স্বাক্ষর না করার কথা বলছে কেউ কেউ, তবে বিএনপির কথাগুলো লিপিবদ্ধ হলে অবশ্যই সনদে স্বাক্ষর করা হবে। এ বিষয়ে শুরু থেকেই ইতিবাচক বিএনপি।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার কালবেলাকে বলেন, আমরা আলোচনা করেছি (গতরাতে)। আমরা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাব এবং স্বাক্ষর করব কি না, সেটা সেখানেই (ভেন্যু) সিদ্ধান্ত নেব।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘জুলাই সনদ' কেবল একটি চুক্তি নয়, এটি বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে সমঝোতা ও সহাবস্থানের একটি দলিল। সনদে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের রূপরেখা। জনগণের মধ্যে ব্যাপক আশা তৈরি হয়েছে যে, এ সনদের সফল স্বাক্ষরের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হবে এবং দেশ এক নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রার পথে পা বাড়াবে। এটি সই হলে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যের সূচনা হবে—এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনমনীয় মনোভাবের কারণে দেশের জনগণ এখন এক প্রকার হতাশার মধ্যে রয়েছে। দেশ এখন এক মহাসন্ধিক্ষণে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তাদের ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে দ্রুত একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। অন্যথায়, ‘জুলাই সনদ’ কেবলই প্রত্যাশিত ইতিহাসের এক অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা সই না হওয়ার জটিলতায় চাপা পড়ে যাবে। জাতির মাহেন্দ্রক্ষণের সেই প্রতীক্ষা কবে শেষ হবে, তার উত্তর এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা ও দূরদর্শিতার ওপর।
মন্তব্য করুন