কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিছক দুর্ঘটনা নাকি ‘আগুন রাজনীতি’

একের পর এক আগুন নিয়ে নানা প্রশ্ন
নিছক দুর্ঘটনা নাকি ‘আগুন রাজনীতি’

গত এক সপ্তাহে দেশজুড়ে তিনটি বড় আগুনের ঘটনা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এসব ঘটনায় শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, দেশের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও বড় প্রশ্ন উঠেছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত ‘আগুন রাজনীতি’। নির্বাচন ভণ্ডুল ও পোশাক শিল্প ধ্বংসে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের নীলনকশা হিসেবেই পরপর তিনটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে কি না—এমন প্রশ্নও উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনায় নাশকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা। এদিকে ধারাবাহিক আগুনের ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছে না খোদ সরকারও।

গত মঙ্গলবার সকালে মিরপুরের রূপনগরে একটি কেমিক্যালের গুদাম ও সংলগ্ন গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগে। এ ঘটনায় ১৬ জন প্রাণ হারালেও মরদেহ শনাক্ত হয় মাত্র ১০ জনের। আগুন পুরোপুরি নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। এ ঘটনার দুদিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামের কেপিআইভুক্ত এলাকায় ঘটে অগ্নিকাণ্ড। ১৭ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই পুরো ভবনটি পুড়ে যায়। এতে কেপিআই এলাকার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ঘটনার দুদিন পর শনিবার আগুন লাগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের কার্গো ভিলেজে।

আট ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিসের সদস্য যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন, ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যায় হাজার কোটি টাকার গার্মেন্টস পণ্যসহ শতাধিক রপ্তানি পণ্য। এটিও কেপিআই এলাকা। পাঁচ দিনের মধ্যে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকেও উঠেছে প্রশ্ন।

বারবার আগুনের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তে জোর দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা—বিশেষ করে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের কারখানা ও মিরপুরের পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা জননিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও শৃঙ্খলা জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’

শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণ বিশ্বাস করে এসব অগ্নিকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘এত বড় অগ্নিপ্রজ্বালন কীভাবে সম্ভব? ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আটকে রেখেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ—এটা কি কেবল বুরোক্রেসি, নাকি এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্র রয়েছে? আজও নাকি চট্টগ্রামে একটি লঞ্চে আগুন লেগেছে। একের পর এক এই আগুন লাগার ঘটনাগুলো কেবল কাকতালীয় নয়, এগুলো জাতিকে ভাবিয়ে তুলছে। এটি কি নাশকতার অংশ নয়?’

বিএনপির এই নেতার অভিযোগ, ‘দেশে স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য একটি মহল সচেষ্ট এবং ভারত সে চেষ্টাকে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে এসেছে। ভারত চায় না বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় থাকুক, বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার আসুক, তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কখনো এটি তারা প্রমাণ করতে পারেনি। তারা বরাবরই শেখ হাসিনার মতো অবৈধ সরকারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।’

সরকারের নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রিজভী। তিনি বলেছেন, ‘সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নস্যাৎ করার চেষ্টা চলছে। পরপর আগুন লাগার এই ঘটনাগুলো কী শুধুই দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত কোনো ষড়যন্ত্র, তা খতিয়ে দেখা দরকার।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘মিরপুর ও চট্টগ্রামের অগ্নিকাণ্ডের পর বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড আকস্মিক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, এ ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন। বিমানবন্দরের মতো কৌশলগত স্থাপনায় এই ঘটনা প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও নিরাপত্তা ঘাটতির প্রমাণ। যদি কোনো গাফিলতি বা নাশকতার উপাদান থাকে, তা দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে তদন্ত করতে হবে। দোষীদের আইনের আওতায় আনা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া সময়ের দাবি। ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলম বলেছেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাকে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না। এগুলো স্বৈরাচারের দোসরদের দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ। তথাকথিত তদন্ত কমিটির নাটক বন্ধ করে এর পেছনের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা জরুরি।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘একই সময়ে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনায় আমরা নাশকতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারি না। সামগ্রিকভাবে মানুষের নিরাপত্তা—বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ ও আশপাশের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার প্রতি আমাদের সম্মান ও দায়বদ্ধতা খুবই কম।’

তিনি বলেন, ‘আইনের দুর্বলতা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জবাবদিহির অভাবেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। আইনের সংস্কার ও বিচারের নিশ্চয়তা না থাকলে এ অগ্নিকাণ্ডের ধারা বন্ধ হবে না।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মনিরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, ‘কেপিআই এলাকায় সবচেয়ে ভালো নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা। এখানে নাশকতা করা খুবই ডিফিকাল্ট (কঠিন)। অভ্যন্তরীণ কারও যদি সংশ্লিষ্টতা না থাকে আমি বুঝে উঠতে পারি না যে, এখানে কীভাবে আগুন লাগল। আমি আসলে কমেন্ট করতে পারি না যে, এটি নাশকতা কি না। তবে আমরা সামনে ইলেকশনের দিকে যাচ্ছি এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করে নির্বাচন পেছানোর কোনো চেষ্টা চালানো হচ্ছে কি না, তা দেখা উচিত। তদন্তসাপেক্ষে বিষয়টি বের হয়ে আসবে।’

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘দুর্ঘটনা কিংবা নাশকতা—কোনোটিকেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুদিন পরপরই দেশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। টঙ্গী, মিরপুর, চট্টগ্রাম এবং সর্বশেষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ইপিজেড ও বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো কেপিআই হিসেবে পরিচিত।’

তিনি বলেন, ‘এ ধরনের স্থাপনায় উন্নতমানের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম থাকার কথা। যদি এমন ব্যবস্থা সত্যিই থাকে, তাহলে সেটি কার্যকর হলো না কেন? ফায়ার টিম থাকার কথা, তারা কেন আগুন লাগার পরও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেনি? বিমানবন্দর এলাকায় সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব দুটি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। মাত্র ৫০ থেকে ১০০ গজ দূরে। তারা কি সময়মতো সংবাদ পেয়েছিল? পেলে তারা সঠিকভাবে রেসপন্স করতে পারল না কেন? আর আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল কেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।’

শাকিল নেওয়াজ আরও বলেন, ‘পুরো সিস্টেমের কোথাও গলদ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিমানবন্দর এলাকায় দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থাই সক্রিয়, তারা কোনো আগাম তথ্য পেয়েছিল কি না, আর পেলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল কি না—এ বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা জরুরি।’

বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘এখন একটার পর একটা অগ্নিকাণ্ড ঘটছে এবং সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বড় ধরনের। সরকার প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডেরই তদন্ত করবে। এর আগে সচিবালয়েও অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল, তারও তদন্ত হয়েছে। আমরা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করেছি। এখন বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডেরও তদন্ত হবে। সেই তদন্ত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী ঘটনা বা পদক্ষেপ সম্পর্কে বলা যাবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কথাকাটাকাটির জেরে হাতাহাতি, সাময়িক বহিষ্কার শিক্ষার্থী

ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু

বিয়ে করতে দিতে হবে মোটা অঙ্কের কাবিন, প্রেমিকের কাণ্ড

‘রঘু ডাকাত’-এর প্রদর্শনীতে নেই রুক্মিণী, অবশেষে মুখ খুললেন নায়িকা

৪৯তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা

ইয়ারবাড পরিষ্কার করার ৫ সহজ ও কার্যকর উপায়

‘ডিডিএলজে’-র ৩০ বছর, সিমরান চরিত্র নিয়ে যা বললেন কাজল

ঠাকুরগাঁওয়ে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

সল্ট-ব্রুকের তাণ্ডবে ইংল্যান্ডের বড় জয়

সেই বাংলাদেশি পর্নো তারকা যুগল নিয়ে যে তথ্য দিল সিআইডি

১০

আজানের মধ্যেই ইমামের টাকা নিয়ে গেল চোর

১১

ফরিদপুরে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

১২

মায়ের অনুপস্থিতিতে দীপাবলিতে বাড়ি সাজাল শুভশ্রী কন্যা

১৩

ত্রিশালে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

১৪

বগুড়ায় সারজিস আলমের অনুষ্ঠানের ভেন্যুতে একাধিক ককটেল বিস্ফোরণ

১৫

প্রধান উপদেষ্টার কাছে ছেলে হত্যার বিচার চাইলেন জুবায়েদের বাবা

১৬

নির্বাচনে সেনাবাহিনী যে ক্ষমতায় থাকবে, জানালেন ইসি সচিব

১৭

জবি শিক্ষার্থী হত্যা : অভিযুক্ত মাহিরকে থানায় দিলেন মা 

১৮

কোটি টাকার সেতুতে বাঁশের মই!

১৯

কেনিয়ার লিগে খেলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এই টাইগার ক্রিকেটার

২০
X