দেশের শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মহাপরিচালকের চেয়ার ঘিরে চলছে নজিরবিহীন দৌড়ঝাঁপ। ১৪ মাসের মধ্যে তিন ডিজি পরিবর্তনের পর নতুন ডিজি নিয়োগে এবার প্রকাশ্যে আবেদন আহ্বান করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, যা শিক্ষা প্রশাসনের ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত। তবে বিজ্ঞপ্তির ইতিবাচক বার্তার আড়ালেই চলছে জোর তদবির, প্রচারণা ও পাল্টা প্রচারণা।
শুধু শিক্ষা ক্যাডারের ১৪ ও ১৬তম ব্যাচেরই অন্তত ৬১ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাউশি ডিজির শূন্য হওয়া পদে বসতে আবেদন করেছেন বলে জানতে পেরেছে কালবেলা। যাদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক কয়েকজন নেতাও। সে তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রীদের একান্ত সচিব (পিএস), সহকারী একান্ত সচিবরাও (এপিএস)। যদিও মোট আবেদন সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দাবি, ডিজি পদে আবেদনকারীর সংখ্যা এরই মধ্যে ২০০ ছাড়িয়েছে।
এর আগে গত ১৪ অক্টোবর নানান বিতর্ক ও নাটকীয়তার পর মাউশি ডিজির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ খানকে। তাকে নিয়ে গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনজন ডিজিকে সরানো হলো। শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ এই পদে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনজন ডিজিকে সরিয়ে দেওয়ার মতো পদক্ষেপের অতীত নজির নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদটিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে অভিন্ন একটি পথে হাঁটছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগের মতোই উন্মুক্ত আবেদনের মাধ্যমে মাউশির ডিজি নিয়োগ দেওয়া হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় চাইছে এমন কাউকে ডিজি করতে, যিনি শিক্ষা ক্যাডারের মধ্যে প্রশাসনিক দক্ষতা, মাঠ বাস্তবতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা—এই তিনটি যোগ্যতার ভারসাম্য রাখতে পারেন। সেজন্য মাউশিতে ডিজির পদায়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও বিতর্কমুক্ত রাখতে দুটি কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে মূল নিয়োগ কমিটির নেতৃত্বে থাকছেন খোদ শিক্ষা উপদেষ্টা। যাতে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের (কলেজ) অতিরিক্ত সচিব মজিবর রহমান।
এ কমিটিতে থাকবেন মন্ত্রণালয়ের আরও পাঁচজন সদস্য। পাশাপাশি জমা পড়া আবেদনগুলো প্রাথমিকভাবে পর্যালোচনার জন্য করা হয়েছে আরেকটি কমিটি। যার আহ্বায়ক করা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিবকে (কলেজ)। এ কমিটি আবেদনগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখবে। এরপর প্রার্থীর যোগ্যতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্য প্রার্থীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে সুপারিশসহ তা মূল নিয়োগ কমিটির কাছে হস্তান্তর করবে। মূল কমিটি সেই তালিকার প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনা করে ডিজি পদের জন্য চূড়ান্ত একটি তালিকা বা সুপারিশ তৈরি করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠাবে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের (কলেজ) অতিরিক্ত সচিব মজিবর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের কমিটির বিষয়ে আমি শুনেছি, তবে অফিসিয়ালি (দাপ্তরিকভাবে) এখনো চিঠি পায়নি। চিঠি পেলেই কাজ শুরু করব।’
কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাউশির ডিজি পদের জন্য এবার যে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে, তা নজিরবিহীন। এবারই প্রথম এ পদের জন্য প্রকাশ্যে আবেদন নেওয়া হলেও প্রার্থীর সংখ্যা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিজি পদের জন্য শুধু ১৪তম এবং ১৬তম বিসিএস ব্যাচ থেকেই ৬১ জন শিক্ষক আবেদন করেছেন। তবে অন্য একটি সূত্রের দাবি, আবেদনকারীর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। আবেদন জমার হিড়িক পড়ার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত এ পদ পেতে প্রার্থীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শুরু করেছেন জোর তদবির।
শিক্ষা প্রশাসনের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে—এসব তদবির ঘিরে নানান গুঞ্জন ও মুখরোচক গল্প। কেউ কেউ আবার একে অন্যকে ঠেকাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের দাবি, যারা আবেদন করেছেন এর বাইরে থেকেও ডিজি নিয়োগ হতে পারে। সেজন্য কাজ করছে সার্চ কমিটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজি হওয়ার দৌড়ে ডজনখানেক কর্মকর্তার নাম জোরালোভাবে আলোচনায় রয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছেন ১৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন উইংয়ের পরিচালক কাজী মো. আবু কাইয়ুম। তিনি ছাত্রজীবনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত ছিলেন ছাত্রদলের রাজনীতিতে। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকারের একজন মন্ত্রীর প্রথমে এপিএস পরে পিএস হিসেবেও দায়িত্ব পালর করেন।
আলোচনায় রয়েছেন মাউশির কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক অধ্যাপক বি এম আব্দুল হান্নান। ১৪তম বিসিএসের এ কর্মকর্তা বর্তমানে মাউশি ডিজির রুটিন দায়িত্বেও রয়েছেন। তিনি গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
দৌড়ঝাঁপ করছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. খন্দকার এহসানুল কবিরও। বোর্ড চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ছিলেন যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের অধ্যক্ষ। ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করেছেন। ডিজি পদের এ দৌড়ে রয়েছেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ ড. ছদরুদ্দীন আহমদ এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের পরিচালক ড. এ কিউ এম শফিউল আজম এবং প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক মো. সাঈদুর রহমান এ পদের জন্য আবেদন করেছেন। তবে তাদের দুজনেরই চাকরির মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর মাসে শেষ হতে যাচ্ছে।
ডিজি পদে আলোচনার তালিকায় রয়েছেন ১৬তম বিসিএসের কর্মকর্তা ও মাউশির মাধ্যমিক শাখার বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেলের নামও। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বহুল আলোচিত শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আলোচনায় থাকা একাধিক প্রার্থী বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ডিজি নিয়োগের বিষয়টিকে সাধুবাদ জানালেও সদ্য সাবেক ডিজির ব্যর্থতায় প্রশাসনে যে ‘অস্বস্তি’ তৈরি হয়েছিল, তা অকপটেই স্বীকার করেছেন কেউ কেউ।
মাউশির পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং) কাজী মো. আবু কাইয়ুম কালবেলাকে বলেন, ‘ডিজি নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি অপ্রচলিত হলেও ইতিবাচক। এতে অনেকের মধ্য থেকে যোগ্য কর্মকর্তাকে বেছে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। সদ্য সাবেক ডিজি অধিদপ্তরটি সামলাতে পারছিলেন না, কারণ তার প্রশাসনিক যোগ্যতা ছিল না। এতে মাউশি চরম অস্বস্তিতে পড়ে। আমাকে ডিজি হিসেবে পদায়ন করলে সেই গ্যাপটা (শূন্যতা) পূরণ করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।’
শিক্ষা ক্যাডার নিয়ে নানান ষড়যন্ত্র চলছে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করা হচ্ছে। দায়িত্ব পেলে এ বিষয়টির সমাধান করব। যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করার এটি মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি সুযোগ, তাই নতুন মহাপরিচালক নিয়োগের কাজটি দ্রুত সময়ের মধ্যে করার দাবি জানাই।’
অন্যদিকে মাউশির কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক এবং বর্তমানে ডিজির রুটিন দায়িত্বে থাকা আব্দুল হান্নানের দাবি, মহাপরিচালকের পদে যেতে কোনো তদবির করছেন না তিনি। আব্দুল হান্নান বলেন, ‘এ পদের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো যোগাযোগ করছি না, সরকার যাকে ভালো মনে করবে, তাকে দায়িত্ব দেবে।’
আর ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. খন্দোকার এহসানুল কবির এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেন, ‘সরকারি চাকরি করি। সরকার যেখানে পদায়ন করবে, সেখানেই দায়িত্ব পালন করব।’
জানা গেছে, এ নিয়োগ প্রক্রিয়াটি শুরু হয় মাউশির সদ্যবিদায়ী মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খানকে সরিয়ে দেওয়ার (ওএসডি) প্রেক্ষাপটে। গত ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক ড. এহতেসাম-উল হককেও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মাউশি ডিজির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার আগে আওয়ামী লীগ সম্পৃক্ততায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভাগিনা অধ্যাপক নেহাল আহমেদের চুক্তি বাতিল করে সরকার।
অর্থাৎ এক বছর দুই মাসে মধ্যে তিনজন ডিজিকে নানা অভিযোগে সরানো হয়েছে। ঘনঘন শীর্ষ পদে এ পরিবর্তনের কারণে এবার সরকার একটি স্বচ্ছ ও স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করে। সেই লক্ষ্যে সম্প্রতি মাউশির শীর্ষ এ পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
মন্তব্য করুন