

রাজধানীর মিরপুরে সরকারি জমি এখন বিভিন্ন আবাসন ব্যবসায়ীর দখলে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) অধিগ্রহণকৃত ১৬৮ একর জমির মধ্যে প্রায় ২০ একর দখলে নিয়েছে পাঁচটি প্রভাবশালী ডেভেলপার কোম্পানি—এশিউর ডেভেলপমেন্ট, সাগুফতা এন এম হাউজিং, হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ, আলিনগর প্রোপার্টিজ ও সিটি লাইফ প্রোপার্টিজ। তারা শুধু জমি দখলই নয়, বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রিও করছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বছরের পর বছর অবৈধভাবে এসব কাজ চলছে। উচ্ছেদ অভিযান ও মামলা হওয়ার পরও বন্ধ হয়নি। গৃহায়নের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আনসার সদস্যরা সরেজমিন গেলে বাধার মুখে পড়ছেন, এমনকি সন্ত্রাসীদের গুলির হুমকিও পাচ্ছেন।
তথ্য বলছে, অবৈধ দখল ও নির্মাণ বন্ধে একাধিক জিডি এবং মামলা হলেও কার্যত কাজ থামেনি। ১৬৮ একর সরকারি জমির প্রায় ২০ একরই এখন এসব কোম্পানির দখলে। এমনকি মসজিদের জমিও ছাড়েনি তারা।
২৬ আগস্ট গৃহায়নের মিরপুর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু হোরায়রা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে সাগুফতা এন এম হাউজিং লিমিটেড, হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ লিমিটেড, এশিউর ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, আলিনগর প্রোপার্টিজ লিমিটেড ও সিটি লাইফ প্রোপার্টিজ লিমিটেডের নিবন্ধন বাতিলের অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে রিহ্যাব ও রাজউককে এসব কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠানোর অনুরোধ করেন। তবে রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১) মো. মনিরুল হক বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে রাজউকে কোনো চিঠি আসেনি, তাই কিছু বলতে পারছি না।’
জানা গেছে, মিরপুরে প্রতি শতাংশ জমির মূল্য জায়গাভেদে কোটি টাকার বেশি। সেই হিসেবে প্রতিটি কোম্পানি শতকোটি টাকার সরকারি জমি দখলে নিয়েছে। অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় তারা নামমাত্র জাল কাগজপত্র তৈরি করে ভবন নির্মাণ শুরু করে। অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মকর্তাই মোটা অঙ্কের বিনিময়ে ভুয়া নথি তৈরি করে দেন, ফলে সরকার বছরের পর বছর বিষয়টি জানতে পারে না।
ক্ষমতার দাপটে সরকারি জমি দখলের প্রতিযোগিতায় জড়িত রয়েছে কয়েকটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী। তাদের মধ্যে এই পাঁচটি কোম্পানি সবচেয়ে সক্রিয়। তারা রাজনৈতিক প্রভাবশালী, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে জমি দখল নিয়ে ব্যবসা ও ফ্ল্যাট বিক্রি করছে। কেউ কেউ দখলকৃত সরকারি জমি অন্যের কাছে ভাড়া দিয়ে অর্থও নিচ্ছে।
প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। ফলে গৃহায়নের কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জমি উদ্ধারে গেলে হামলার শিকার হচ্ছেন। দখলদার বাহিনীর গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটেছে।
গৃহায়নের কর্মকর্তারা জানান, মিরপুর বাউনিয়া মৌজার সিএস ৩১২৮ দাগের ২.০১ একর জমি দখল করে রেখেছে এশিউর গ্রুপ। ৩১ আগস্ট গৃহায়ন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে জমি দখলমুক্ত করে দেয়াল ও আনসার শেড নির্মাণ শুরু করে। কিন্তু ৬ সেপ্টেম্বর এশিউর গ্রুপের লোকজন কর্মকর্তা, আনসার সদস্য ও শ্রমিকদের ওপর হামলা চালায়। এতে কয়েকজন আহত হন। ১৬ সেপ্টেম্বর ফের দেয়াল নির্মাণ শুরু করলে হেলমেট পরা ৪০-৫০ জন সন্ত্রাসী গুলি চালায়। ওইদিনই গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু হোরায়রা পল্লবী থানায় এশিউর গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ১০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
তিনি বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযান চালালে হামলা হয়। অবৈধ দখল ও নির্মাণ বন্ধে মামলা করেও কাজ বন্ধ হয়নি। আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।’
নথি অনুযায়ী, বাউনিয়া মৌজায় এল এ কেস নম্বর ১৩/৫৯-৬০, ৯০/৬৫-৬৬ ও ৫/৭২-৭৩ মূলে সিএস ৩১২৪ ও ৩১২৮ দাগে মোট ১৬৮ একর জমি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণে আছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ব্যবস্থাপনার অভাবে এই জমি বেহাত হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, সাগুফতা হাউজিং, হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ, এশিউর ডেভেলপমেন্ট, আলিনগর প্রোপার্টিজ, সানভিউ টাওয়ারস, সিটি লাইফ প্রোপার্টিজসহ অন্তত পাঁচটি কোম্পানি মিলে প্রায় ২০ একর জমি দখল করেছে। এর আর্থিক মূল্য হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিশেষ করে সিএস ৩১২৮ দাগের ১৪.৫৮ একর জমি এখন সাগুফতা, হ্যাভেলি, আলিনগর ও সিটি লাইফ প্রোপার্টিজ লিমিটেডের দখলে। এমনকি সাগুফতা হাউজিং এই জমির কিছু অংশ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রিও করেছে। গৃহায়ন মালিকানাধীন জমি তারা ভুয়া কাগজপত্রে নিজেদের নামে নিয়েছে। এ ছাড়া আরও প্রায় ১০ একর জমি জেলা প্রশাসকের নামে রয়েছে।
গত বছর অক্টোবরে গৃহায়ন রাজউককে চিঠি দিয়ে এসব দখলদার কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায় এবং জানায় যে, প্রায় ২০ একর জমি দখলে রয়েছে।
গৃহায়নের কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, মিরপুরে প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ৪৫ লাখ টাকা। সে হিসেবে এক একর জমির সরকারি মূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। শুধু এশিউরের দখলে থাকা ২.১ একর জমির সরকারি মূল্য শতকোটি টাকার বেশি। বাস্তবে বাজারদর সরকারি মূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি সরকারি সম্পত্তি দখলে নিয়েছে এসব কোম্পানি।
স্থানীয় হাউজিং প্রতিষ্ঠান সাগুফতা হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জুয়েল মোল্লা প্রায় ১২ একর সরকারি জমি দখলে নিয়েছেন। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার ভাতিজা। দখল পাকাপোক্ত করতে তিনি সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ ও আমলাদের নামমাত্র মূল্যে জমি লিখে দেন, এরপর ভবন তৈরি করে ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু করেন।
এ ছাড়া সাগুফতা এন এম হাউজিং লিমিটেড আরও ৯ কাঠা জমি দখল করেছে—মো. মঞ্জুর উল হকের প্লট নং ৩৮৬৪, ব্লক-এল (৩ কাঠা), মো. শহীদ উল হকের প্লট নং ৩৮-৩৯, ব্লক-এল (৩ কাঠা) এবং মো. লুৎফুল হাবিবের প্লট নং ৩৮৬৫, ব্লক-এল (৩ কাঠা)। জমির বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। জমির মালিকরা গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। ৯ জুলাই গৃহায়নে শুনানির সময় কোম্পানির কর্মকর্তা ও এমডির পিএস সৈয়দ শফিকুজ্জামান উপস্থিত হয়ে বিষয়টি স্বীকার করেন।
জাতীয় গৃহায়নের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু হোরায়রা বলেন, ‘গত সোমবার মিরপুর ১২-এর ৯ নম্বর সেকশনে বাউনিয়া মৌজার স্বপ্ন নগর আবাসিক এলাকার পাশে জাতীয় গৃহায়নের ২.০১ একর জমিতে হেলমেট পরা ৪০-৫০ জন এসে তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালায়। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, লোকজন দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। হামলায় কয়েকজন আনসার সদস্য ও গৃহায়নের কর্মচারী আহত হন।’
সরকারি সম্পত্তি দখল ও সন্ত্রাসী হামলার এই ভয়াবহ চিত্র এখন মিরপুরের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। তারা বলছেন, ‘সরকারের জমি গায়েব হচ্ছে, কিন্তু প্রশাসন নীরব।’
সাগুফতা হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জুয়েল মোল্লার পিএস সৈয়দ শফিকুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, এ দেশে জাতীয় গৃহায়ন মানুষের জমি দখল করেছে। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। সরকারি জমি দখল করেছে সাগুফতা হাউজিং—এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি হুমকি দেন এবং বলেন, ক্ষমতা থাকলেই দখল করে। গৃহায়নও জমি দখল করেছে, এই বিষয়ে লিখতে পারবেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে এশিউর ডেভেলপমেন্টের ম্যানেজার ফারুক হোসেনকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
হ্যাভেলি ও আলীনগর প্রোপার্টিজের এমডি এ কে এম এ আউয়ালকেও একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সানভিউ টাওয়ার্স সভাপতি মো. সাইফুল কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা কোনো সরকারি জায়গা দখল করিনি। এশিউর কোম্পানি জায়গা দখল করেছে। এখন সেখানে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ওয়াল করছে। আমাদের যে জমি, তা সরকারের নয়, পাবলিকের।’
সিটি লাইফ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর শফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে জমির কাগজপত্র আছে। এই জমির ট্যাক্স ও খাজনা যা-ই বলেন না কেন, সবকিছু দিয়ে আসতেছি; কিন্তু এই জমি যে জাতীয় গৃহায়নের, তার কোনো প্রমাণ তো তাদের কাছে নেই এবং আমার কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করার জন্য তারা যে চিঠি দিয়েছে, তাও জানি না।’
মন্তব্য করুন