কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আট ঘণ্টায় আরও তিন ভূমিকম্প, বাড়ল ভয়-আতঙ্ক

একটির উৎপত্তিস্থল ঢাকা
আট ঘণ্টায় আরও তিন ভূমিকম্প, বাড়ল ভয়-আতঙ্ক

শুক্রবারের প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের রেশ না কাটতেই গতকাল শনিবার ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে আরও তিনটি মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায়। এ নিয়ে গত ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্পে জনমনে আরও ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘন ঘন ভূকম্পনের এ ঘটনায় বিশেষজ্ঞরা এটিকে ভালো লক্ষণ নয় বলে সতর্ক করেছেন। যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার, প্রশাসন ও সাধারণ মানুষকে চরম সতর্কতা এবং প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

শুক্রবার ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর গতকাল প্রথম কম্পনটি হয় সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে, যার মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৩। উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৯ কিমি উত্তর-পূর্বে নরসিংদীর পলাশে। সন্ধ্যায় ঢাকার বাড্ডায় দুবার ভূমিকম্প হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির জানান, সন্ধ্যায় রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর ১ সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল বাড্ডায়। আর ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে।

শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা। শুক্রবারের ভূমিকম্প সারা দেশেই অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের সময় অনেকেই আতঙ্কে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন। ভূমিকম্পের ঘটনায় শিশুসহ ১০ জন নিহত ও ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি—পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে অনেকেই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন। এ ছাড়া কিছু ভবন হেলে পড়ে এবং ফাটল দেখা দেয়।

এদিকে ধারাবাহিক কম্পনের ফলে গাজীপুর-টঙ্গী শিল্পাঞ্চল থেকে শুরু করে নরসিংদী, বগুড়া এবং চট্টগ্রামে পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। টঙ্গী ও গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানায় হুড়োহুড়ি ও বিশৃঙ্খলার ফলে দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। অন্যদিকে, নরসিংদীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেড় শতাধিক কাঁচা ও আধাপাকা ভবন। বিশেষজ্ঞদের মতে, টানা দুদিনে তিনটি ভূমিকম্পকে সাধারণভাবে দেখার সুযোগ নেই এবং ঢাকার নিম্নাঞ্চলসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর জন্য এটি এক বড় সতর্কবার্তা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, এর আগে এ অঞ্চলে ৪ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়নি। তিনি সতর্ক করে বলেন, বড় ভূমিকম্পগুলো ১৫০ বছর পরপর ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। এদিক থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার সময় হয়ে গেছে। তাই শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর সবাইকে সচেতন ও সাবধান হতে হবে। বিশেষ করে শনিবার আরও তিন দফা ভূমিকম্প হওয়া লক্ষণ ভালো নয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ জানান, ঢাকার নিম্নাঞ্চলগুলোতে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেশি। তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকের পর থেকে যেসব নিম্নভূমিতে বালু ফেলে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা করা হয়েছে, যেমন হাজারীবাগ, শ্যামলী, ঢাকা উদ্যান, বছিলা, পূর্বাচল ও উত্তরা। এসব অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এখানকার ভবনগুলো ঢাকার উঁচু এলাকার ভবনের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। গত দুদিনে চারটি ভূমিকম্পনকে সাধারণভাবে দেখার সুযোগ নেই। যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার, প্রশাসন সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে সাবধান ও অতিক সতর্ক থাকতে হবে। মোট কথা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

এদিকে টানা দুদিনের ভূমিকম্প, বিশেষ করে গাজীপুর-টঙ্গী, নরসিংদী শিল্পাঞ্চলে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার সকালের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর গতকাল আরও তিনটি ভূমিকম্প হওয়ায় রাজধানী, টঙ্গী, গাজীপুর শিল্পাঞ্চলসহ সারা দেশে সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দুদিনের ভূমিকম্পে টঙ্গী ও গাজীপুরে বিভিন্ন কারখানায় প্রায় ৩ হাজার শ্রমিকের মধ্যে হুড়োহুড়ি ও বিশৃঙ্খলার ফলে দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। সিঁড়িতে ধাক্কাধাক্কি ও চাপাচাপিতে তাদের হাত ভাঙা, পা মচকানো বা মাথায় আঘাতের মতো ঘটনা ঘটে। একই ঘটনায় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ৩০ জন কিশোরও আহত হয়। আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা চলছে টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল ও স্থানীয় হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মূলত আতঙ্ক দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং নিরাপদে ভবন ছাড়ার পদ্ধতির অভাব এ বিশৃঙ্খলার মূল কারণ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নগর ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি বিশেষ কন্ট্রোল রুম চালু করেছে, যা ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকবে।

নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার ও গতকালের ভূমিকম্পের পর ঘোড়াশাল সার কারখানা এবং ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনো চালু করা যায়নি। গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতত্ত্ব বিভাগের অনারেবল অধ্যাপক ড. আ স ম উবাইদুল্লাহর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি টিম নরসিংদীর ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছে।

এ সময় ড. আ স ম উবাইদুল্লাহ বলেন, আমরা এখন ভূমিকম্পের উপাত্ত সংগ্রহ করছি। এ ভূমিকম্পের ফলে পৃষ্ঠের মধ্যে কী কী নিদর্শন আছে, যেগুলো ভূমিকম্পের সঙ্গে জড়িত, আমরা তা পর্যবেক্ষণ করছি। যে ফাটলগুলো তৈরি হয়েছে, এগুলো ভূমিকম্পের কারণে অথবা কম্পনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে।

শুক্রবারের ভূমিকম্পে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কমবেশি দেড় শতাধিক কাঁচা, আধাপাকা ও বহুতল ভবনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভবনে ফাটল ধরে ক্ষতি হয়েছে পলাশ উপজেলায়। পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুবক্কর সিদ্দিকী জানান, উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকায় ৩০টি ভবনে আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিস্তারিত জানার জন্য কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে এবং সার্বিক পরিস্থিতি খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।

বগুড়া ব্যুরো জানায়, শুক্রবার ও গতকালের ভূমিকম্পে বগুড়া শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই ঘর থেকে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। ভূমিকম্পটি কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী থাকলেও মানুষের ভয়ের মাত্রা ছিল তীব্র। ভূমিকম্পের প্রভাবে বগুড়ায় সামান্য ক্ষতির তথ্য মিলেছে। কাহালু উপজেলার মুরইল এলাকায় সুনীল সরকারের বাড়ির লোহার গেট ভেঙে পড়ে। তবে এতে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ভূমিকম্পের সময় সাধারণ মানুষের আতঙ্ক ছিল স্পষ্ট। শহরের চেলোপাড়ার এলাকার শিক্ষক গৌরব চন্দ্র দাস বলেন, ‘হঠাৎ দেখি বিছানা নড়ছে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, তীব্রতা বুঝে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে যাই।’

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, দেশের অন্যান্য জায়গার মতো চট্টগ্রামেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এতে উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আগে থেকে হেলে থাকা একটি ভবন আরও একটু হেলে গেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় ভবনে বসবাসরতদের সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করেছে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল। নগরীর মনছুরাবাদ এলাকায় ভবনটির অবস্থান। ভবনটির মালিক সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম।

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার ও গতকালের চার দফা ভূমিকম্পের পর পোশাক শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় আশুলিয়ার বাইপাইলে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রমিক কিংবা গার্মেন্টস কর্মীদের ভূমিকম্পের কারণে অনেকেই ভয়ে কারখানায় ঢুকতে চায়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা ছাড়লেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী

যুবদল নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

জবি শিক্ষার্থীদের বাস সেবা দিতে চায় শিবির, অনুমতি দেয়নি কমিশন

ইউক্রেন শান্তি চুক্তি আলোচনায় বড় অগ্রগতি

এসএসসি পাসে মীনা বাজারে চাকরির সুযোগ

বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণচেষ্টা

পুরুষদের প্রস্টেট চেক করানো কেন জরুরি

১০৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ৫২ জনের গণশুনানি

বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে দিল্লি, দ্বিতীয় ঢাকা

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হওয়া ছাড়া উপায় নেই : ইরান

১০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুপক্ষের সংঘর্ষ, টেঁটাবিদ্ধে বৃদ্ধ নিহত

১১

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

১২

হুমকির মুখে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও জাতীয় গ্রিড লাইন

১৩

স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার পদত্যাগ

১৪

আজ ঢাকার আবহাওয়া যেমন থাকতে পারে

১৫

আড়ং ডেইরিতে নিয়োগ, দ্রুত আবেদন করুন

১৬

২৪ নভেম্বর : ইতিহাসের এই দিনে যা ঘটেছিল

১৭

নাশতায় যেসব খাবার নীরবে বাড়াচ্ছে আপনার রক্তচাপ

১৮

২৪ নভেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

২০
X