আসন্ন রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে শুরু থেকেই বিএনপি-জামায়াতের কোনো মেয়র প্রার্থী ভোট করছেন না। ভোটের মাঠে ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী। বরিশাল সিটি নির্বাচন ইস্যুতে পাতপাখাও ছেড়েছে মাঠ। এর মধ্যে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে নির্বাচনী মাঠ সরগরম রেখেছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত রাসিক নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সিলেট সিটি করপোরেশনে গত দুই মেয়াদে (১০ বছর) মেয়রের চেয়ার ছিল বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরীর দখলে। ফলে নগরে ভোটের মাঠে আধিপত্য গড়ে তোলেন আরিফ। করোনায় বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের মৃত্যুতে সিলেট নগরে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সংকট দেখা দেয়।
আরিফুল হক চৌধুরীকে মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য থেকে এনে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর হাতে তুলে দেওয়া হয় নৌকার প্রতীক। সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের শূন্যস্থান পূরণে নগরবাসীকে আপন করে নিতে শুরু করেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় ভোটযুদ্ধ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন আরিফুল হক চৌধুরী। সেই সঙ্গে দলের আনুগত্য স্বীকার করে প্রায় দেড় ডজন বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীও রণে ভঙ্গ দেন। তবে বিএনপির নির্দেশ অমান্য করে প্রার্থী হন দলের ৪৩ নেতাকর্মী। যাদের দল থেকে এরই মধ্যে বহিষ্কারও করা হয়েছে। সিলেট সিটি নির্বাচন যখন সন্নিকটে, তখনই সামনে এসেছে ভোটারদের উপস্থিতির বিষয়টি।
রাসিক পরিস্থিতি : ভোট-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজশাহী সিটি নির্বাচন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। এখানে দলীয় বিষয় বেশি প্রাধান্য পাবে না। এ ছাড়া মেয়র প্রার্থী লিটন নগরীর যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন, তা অব্যাহত রাখতে হলেও ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন। তারা বলছেন, অন্য সিটির নির্বাচন রাজশাহীর ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হবে না। এখানে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পড়বে আশা করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভোটের ঠিক এক সপ্তাহ আগে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভোট বয়কটের পর অনেকটা নাটকীয় মোড় নিতে চলেছে রাসিক নির্বাচন। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় এমনিতেই এ সিটির নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এর পরও দেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনী কাঠামোটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনে হচ্ছিল। কিন্তু একটি দল শেষ দফার সিটি নির্বাচন বয়কটের ঘোষণার মুহূর্তেই যেন সব পট পরিবর্তন হয়েছে। বলা হচ্ছে, অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অনেকটাই প্রতিদ্বন্দ্বীহীন হয়ে পড়ল। এমন পরিস্থিতিতে মেয়র প্রার্থী লিটনের জন্য ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে এমন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশবাসীকে দেখিয়ে দিতে চান নৌকার এ হেভিওয়েট প্রার্থী। ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, এবার হবে কর্মসংস্থান’ স্লোগানে গত ২ জুন প্রচারণা শুরুর দিন থেকেই নৌকা প্রতীকের পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুনে পুরো শহর মোড়ানো হয়েছে। বিরামহীনভাবে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন নৌকার মাঝি সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও তার কর্মী বাহিনী। তারা বলছেন, নগরজুড়ে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটির কারণেই দল-মত নির্বিশেষে ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই রাসিক নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। রাসিকের রাজস্ব খাতে প্রায় শতকোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে রাসিকের দায়িত্ব নেন তিনি। ২১ মে রাসিকের রাজস্ব খাতের তহবিলে প্রায় ৪০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রেখে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে লিটন প্রথমবারের মতো রাসিক মেয়র নির্বাচিত হন।
এরপর ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি রাজশাহী মহানগর যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের কাছে পরাজিত হন। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচনে তিনি ফের মেয়র হন। এরপর রাজশাহী মহানগর পায় নতুন মাত্রা। গত পাঁচ বছরে সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাজশাহীর দ্যুতি ছড়িয়েছে প্রতিবেশী ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও।
এত কিছুর পরও রাসিক নির্বাচন নিয়ে প্রকৃত অর্থেই নির্ভার হতে পারছেন না নৌকার মেয়র প্রার্থী লিটন। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় একদিকে আগে থেকেই এ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন বলছিল একটি পক্ষ। এর পরও দেশের এত রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংসদীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাকের পার্টির তিন মেয়ের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এসে নির্বাচনী কাঠামো অক্ষুণ্ন রাখেন। তবে রাসিক নির্বাচনের শুরু থেকেই তাদের প্রাণহীন প্রচার-প্রচারণা নিয়ে নগরজুড়ে নানা ধরনের গল্প ডালপালা মেলেছে।
সেই গল্পের কফিনে যেন শেষ পেরেক ঠুকে দিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়ার ঠিক আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে দলটি। বয়কটের সিদ্ধান্ত দলটির শীর্ষ নেতার হলেও রাজশাহীতে গত সোমবার সন্ধ্যায় এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন হাতপাখা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মাওলানা মুরশীদ আলম ফারুকী।
রাসিকের মেয়র পদে চার প্রার্থীর মধ্যে খায়রুজ্জামান লিটন বাদে অন্য দুজন হলেন জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম স্বপন (লাঙ্গল) ও জাকের পার্টির লতিফ আনোয়ার (গোলাপফুল)।
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র প্রার্থী লিটনের নির্বাচনী প্রচার কমিটির মিডিয়া সেলের প্রধান আহসানুল হক পিন্টু বলেন, এখন পর্যন্ত শতাধিক নির্বাচনী সভা, সমাবেশ ও গণসংযোগ করা হয়েছে। এটি প্রচারণা শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আমাদের লক্ষ্য সবাইকে ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করা। কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যেন তারা ভোট দেওয়া থেকে বিরত না থাকেন। কেন্দ্রে যেন স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে।
মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আমাদের লক্ষ্য ৭০ শতাংশ ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। সেটা আমরা করতে পারলে সব ক্ষেত্রে সফল হব। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারব, শত ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে বিপুলসংখ্যক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদের বিজয়ী করেছে। অতএব, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
নির্বাচন বিশ্লেষক সুব্রত কুমার পাল বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই। মেয়র পদে কে জয়ী হবেন, তা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপরও যেহেতু বিভিন্ন দলের কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোট করছেন। তারা নিজেদের প্রতিবেশী, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তবে এ সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি মনে হয় না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, ভোট বর্জনের জন্য বিরোধী দলগুলো খুব সোচ্চার নয়। মে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে যত ভোট পড়ত, সেটা হয়তো হবে না। অবশ্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর কারণে কিছু ভোটার ভোট দিতে যাবে। সবকিছু বিবেচনায় ভোট খারাপ হবে বলে মনে হয় না। তবে কেন্দ্রে ভোটারদের নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জটাও কম নয়।
সিসিকে রাজনৈতিক পট
সিলেট নগরীতে আরিফুল হক চৌধুরী ও বিএনপির সমর্থিত অন্তত ২৫ ভাগ ভোটার ব্যতিরেকেও নীরব ভোটার রয়েছেন অন্তত ৪০ ভাগ। এসব ভোটারের কেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করার প্রয়াস বিএনপি চালিয়ে যাচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীও ভোট বর্জনের ঘোষণায় ভোটারদের কেন্দ্রে আনা কিংবা উপস্থিত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সিলেটেও।
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, সিলেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। প্রচারে গিয়ে ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে আমাকে ভোট দেবেন আশা করছি। ভোটারদের উপস্থিতির ব্যাপারেও আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছি।
তবে জাতীয় পার্টির মেয়রপ্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুলের প্রধান সমন্বয়ক জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, বরিশাল সিটি নির্বাচন সিলেটে ভোটারদের উপস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
এদিকে নির্বাচন বর্জন করে দল থেকে বহিষ্কারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিএনপির ৫০ ও জামায়াতের ২০ নেতাকর্মী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। কাউন্সিলর পদে ভোট দিতে বিএনপি-জামায়াতের ভোটাররা যদি কেন্দ্রে যান, সে ক্ষেত্রে মেয়র পদে কাকে ভোট দেবেন সেটি এখন আলোচনার বিষয়। তাই ভোটের হিসাব-নিকাশে সরকারবিরোধী ‘ভোটব্যাংকের’ দিকে নজর রাখছেন মেয়র প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিপরীতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম (বাবুল) আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধী ভোট টানতে পারেন, সাধারণভাবে এমন ধারণা করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। তবে বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকজন নেতা বলছেন, তাদের দল নির্বাচন বর্জন করায় কর্মী-সমর্থকরা ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন না।
জানা গেছে, দলীয় ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে বিএনপি তৎপর। আর আওয়ামী লীগ চিন্তা করছে, বিএনপি-জামায়াত সমর্থক বা ভোটাররা কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য হলেও ভোটকেন্দ্রে যাবেন।
অপর দিকে সরকারবিরোধী ভোট আছে, এমন ওয়ার্ডে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াতে করণীয় ঠিক করছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। তবে জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের ২০ জনের মতো কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। ফলে ভোটকেন্দ্রে ভোটার টানবেন কাউন্সিলররা।
অন্যদিকে বিএনপির মনোনয়নে টানা দুবার মেয়র নির্বাচিত হওয়া আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমরা বিএনপির ভোটারদের কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এ ভোট নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই।
মন্তব্য করুন