রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরের ব্যস্ততম সড়ক হাজীপাড়া রোড। তবে এটি সর্বাধিক পরিচিত ঢাকা কমার্স কলেজ এলাকা হিসেবে। কলেজের পাশেই গড়ে উঠেছে ঝিলপাড় বস্তি। বস্তির কেউ কেউ ঘরের মালিক, তবে বেশিরভাগই দিনমজুর ভাড়াটিয়া। এই বস্তিতে হাজারো মানুষ বসবাস করছেন ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে। বিদ্যুতের খুঁটি থেকে অবৈধ ও বিপজ্জনক সংযোগ নিয়ে চলছে বস্তি। দীর্ঘদিন ধরে বস্তির জনগণ প্রতিবাদ করলেও মেলেনি প্রতিকার। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার রাতে। তুমুল বৃষ্টিতে জমে থাকা পানিতে অবৈধ সংযোগের তার ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় চারজনের। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের টাকা দিয়ে বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় বস্তির ঘর মালিকরা।
ওই দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মো. মিজান (৩০), তার স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫), মেয়ে লিমা (৭) ও তাদের উদ্ধার করতে যাওয়া মোহাম্মদ অনিক (২০)। তারা সবাই ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা।
সরেজমিন দেখা যায়, বস্তিতে প্রবেশের জন্য একটি সরু অন্ধকার আধাপাকা রাস্তা। প্রবেশ করতেই মাথার ওপরে দেখা মেলে ঝুলে থাকা বৈদ্যুতিক তারের। ঘিঞ্জি পরিবেশে লাগোয়া শত শত ঘর। এসব ঘর নিয়ন্ত্রণ করে বেশ কয়েকজন মালিক। বস্তিতে যার ঘর বেশি, তার ক্ষমতাও বেশি। বস্তির উল্টোপাশেই দেখা যায় চার-পাঁচটি বিদ্যুতের খুঁটি। বস্তির অন্যপাশের বহুতল ভবনের বাসিন্দারা বৈধ মিটারের মাধ্যমে সেখান থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছে। আর এই খুঁটিগুলো থেকেই অবৈধভাবে লাইন নিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে বস্তিতে। যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু কর্মচারীরাও।
দেখা যায়, মিরপুর হাজীপাড়া নামে এই এলাকার বৈদ্যুতিক পিলার থেকে অবৈধভাবে লাল এবং সবুজ তার দিয়ে লাইনগুলো রাস্তার নিচ দিয়ে চলে গেছে বস্তিতে। বস্তির মুখেই দুই রাস্তার মাঝখানে একটি ড্রেন। বৃষ্টি হলে বা পানি জমলে এই ড্রেন দিয়ে পানি চলে যেত বস্তির পেছনের ঝিলে। কিন্তু বেশ কিছু স্থাপনা দিয়ে জায়গা দখল করে ড্রেনের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এখন ড্রেনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে রাস্তার নিচ দিয়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের লাইন নিয়ে প্রবেশ করানো হয় বস্তিতে। এলাকাবাসী জানায়, বস্তির পাশের একটি হোস্টেল এবং মাদ্রাসা থেকে কয়েকবার বিদ্যুৎ অফিসে জানানোর পর লাইনগুলো কাটা হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরই আবারও লাইন সংযোগ দেয় দখলদাররা। তবে বৃহস্পতিবার রাতের ওই ঘটনার পর গতকাল সকালে কিছু লোক এসে অবৈধ সংযোগের লাইনগুলো খুলে নিয়ে যায়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় মোল্লা সেলিম, লাইলী বেগম, মোমেন, আলাউদ্দিন, আলমগীরসহ বেশ কয়েকজন এই অবৈধ সংযোগ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা বস্তির ঘরের মালিক। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় কাউন্সিলর এবং রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন টেনুর ছত্রছায়ায় তারা এসব করে। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই করা হয় মারধর। কাউকে আবার মাদক মামলায় দেওয়া হয় পুলিশে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের টাকা দিয়ে এবং সাধারণ বস্তিবাসীকে হুমকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বাণিজ্য।
বস্তির উল্টোপাশের বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাদের বিদ্যুতের সংযোগের খুঁটিগুলো থেকে অবৈধভাবে লাইন দেওয়া হয়েছে বস্তিতে। এতে কয়েকদিন পরপর তাদের বিদ্যুৎ সংযোগে ঝামেলা দেখা দেয়। কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। বিষয়গুলো নিয়ে স্থানীয় বিদ্যুৎ বিভাগকে বারবার বলা হলেও এসব ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিদ্যুতের লাইনম্যানরা ১০০-২০০ টাকা নিয়ে এই অবৈধ সংযোগগুলো বস্তিতে দিচ্ছে। এর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীরাও জড়িত।
বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের কারণেই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই বস্তির প্রায় সব ঘরে অবৈধ সংযোগ নেওয়া। নামমাত্র কয়েকটি মিটার দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে আশপাশের ভবনের ওয়াল ছুঁলে এবং রাস্তায় দাঁড়ালে বিদ্যুতের শক পাওয়া যায়। এগুলো নিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। ডেসকোর লোকজন, স্থানীয় প্রভাবশালী সবাই টাকা খেয়ে এই কাজগুলো করছে।
বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফারুক মিয়া বলেন, মানুষগুলো বিদ্যুতের শকে একদম রাস্তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল রাস্তা থেকে তাদের টেনে ধরছে। অনেক মানুষ চেষ্টা করলেও তাদের ওঠাতে পারছিল না। রাস্তার নিচ দিয়ে নেওয়া অবৈধ বিদ্যুতের লাইন থেকেই এই বিদ্যুৎস্পর্শের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) সুপারভাইজার মঞ্জুরুল ইসলাম দাবি করেন, বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টির মধ্যেই তাদের একটি টিম ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। সেখানে কোনো বিদ্যুতের ছেঁড়া তার পাওয়া যায়নি। তবে এ ঘটনায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দুঃখ প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা ও তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রাহকের ইন্টারনাল সার্ভিসের ওয়ারিং ত্রুটির কারণে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তদন্ত করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
বস্তিতে অবৈধ লাইনের বিষয়ে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী কাওসার আমীর আলী কালবেলাকে বলেন, অভিযোগ পেলেই অভিযান চালাই। ওই বস্তি অনেক ঘিঞ্জি, সবসময় লাইন দেখভাল করা যায় না। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কেউ যদি অবৈধ সংযোগ দেওয়ায় যুক্ত থাকে, তাহলে প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে বিভিন্ন স্থাপনার মাধ্যমে ড্রেনের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) সেলিম রেজা বলেন, এ বিষয়ে করপোরেশনে কেউ কখনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।
দুর্ঘটনার বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার ওসি মো. মহসীন কালবেলাকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়টি উঠে এসেছে। যার কারণে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় নিহত যুবক অনিক মিয়ার বাবা বাবুল মিয়া অবহেলাজনিতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে মৃত্যু ঘটনার অপরাধে মামলা করেছেন। এ ঘটনায় বিস্তারিত তদন্ত চলছে। কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা খুঁজে বের করা হবে।
মন্তব্য করুন