বৃহস্পতিবার রাতের টানা বৃষ্টির পানিতে রাজধানীর মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তির সামনে কোমর সমান পানি জমেছিল। ড্রেনের আবর্জনা আর অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইনের ছেঁড়া তারে সেই জায়গাটা হয়ে উঠেছিল বিপজ্জনক। সেই পানি মাড়িয়ে বাসায় ফেরার পথে এক পরিবারের চারজন বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে বাঁচার জন্য ছটফট করছিলেন। পরিবারটিকে রক্ষায় প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মী মেলেনি, দুর্ভোগে পাশে পাওয়া যায়নি কোনো জনপ্রতিনিধিকেও। এগিয়ে এসেছিলেন তরুণ অনিক মিয়া। সেই মৃত্যুফাঁদে নিজের জীবন দিয়েছেন, বাঁচিয়েছেন ফুটফুটে সাত মাসের এক শিশুকে।
মোহাম্মদ হোসাইন নামে শিশুটিকে বাঁচানোর দৃশ্য ধরা পড়েছে সেখানে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে, অনেকে মোবাইল ফোনেও করেছেন ভিডিও। তা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মানুষ দেখেছে, অনিকের বীরত্ব, দেখেছে কীভাবে এক শিশুকে বাঁচিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টির পানির ভোগান্তি, এক পরিবারের তিনজনের মৃত্যু—সবকিছু ছাপিয়ে এখন এক বীরের নাম অনিক মিয়া, পেশায় যিনি অটোরিকশাচালক। তিনি প্রমাণ করেছেন, মরেও বেঁচে থাকা যায়, এক শিশুর জীবন বাঁচিয়ে মরেও মানুষের মনে বেঁচে আছেন অনিক।
বৃহস্পতিবার রাতের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর সড়ক যেন নদীতে রূপ নিয়েছিল। চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠেছিল ঘরেফেরা মানুষের জন্য। সেই রাতে ঘরেই ফিরছিলেন মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৩০)। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী মুক্তা আক্তার (২৫) ও সাত বছর বয়সী মেয়ে লিমা আক্তার, আর ৭ মাসের ছেলে মোহাম্মদ হোসাইন। তবে মিরপুরে কমার্স কলেজসংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে রাস্তায় বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মিজান, মুক্তা ও মেয়ে লিমা ঘটনাস্থলেই মারা যান। পানিতে ভাসছিল ছোট্ট মোহাম্মদ হোসাইন। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ যায় ১৮ বছর বয়সী অনিক মিয়ার। চিকিৎসা শেষে বাবা-মা ও বোন হারানো হোসাইন এখন তার নানির কাছে রয়েছে।
অনিকের জীবনের বিনিময়ে বাঁচল শিশুটি: বাবা, মা ও বোন হারালেও পানিতে বেঁচেছিল মোহাম্মদ হোসাইন। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে বেঁচে রইল ছোট্ট শিশুটি, তা নিয়ে গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থলে কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে। অনিক বিদ্যুতায়িত পানির মধ্য থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) একজনের কাছে ছুড়ে মারেন। আমেনা নামে ওই হিজড়া ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, হোসাইন তার মা মুক্তার আক্তারের কোলে ছিল। মা যখন পানিতে পড়ে যায়, তখন শিশুটি মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে যায়। ওই সময় অনিক সঙ্গে সঙ্গে এসে শিশুটিকে পানি থেকে তুলে আমার কাছে ছুড়ে দেয়। এর পরই অনিক পানিতে শুয়ে পড়ে, তাকেও কারেন্টে ধরে ফেলে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বৃষ্টির পানিতে মিরপুরে হাবুডুবু খাচ্ছিল শিশুটি। হাঁটুপানিতে তখন ছোট্ট একটি পা দেখা যাচ্ছিল। ওই সময় কালো প্যান্ট পরে খালি গায়ে এসে এক ব্যক্তি তার পা ধরে টেনে তুললেন। ডান পা ধরে টেনে তুলতেই দেখা যায়, ছোট্ট শিশুটিকে। পরনে নীল হাফপ্যান্ট ও সাদা গেঞ্জি। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, শিশুটির পা ধরে টেনে তুলে এক নারীর হাতে তাকে তুলে দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। শিশুটিকে হাতে নিয়েই কান্নাকাটি আর ছোটাছুটি করছেন ওই নারী।
গতকাল ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দারা জানান, খালি গায়ে কালো প্যান্ট পরা ব্যক্তিই অনিক মিয়া, আর শিশুটি মোহাম্মদ হোসাইন। যে নারীকে দেখা যাচ্ছে, তিনি আমেনা হিজড়া।
অনিকের এক বন্ধু কালবেলাকে জানিয়েছেন, তার বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ী। বৃষ্টি হওয়ার আগের দিন বুধবারই অনিকের সঙ্গে তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে অনিক বাসাতেই ছিলেন। বৃহস্পতিবার অটোরিকশা নিয়ে বের হননি।
অনিকের অটোরিকশার মালিক কবির হোসেন বলেন, অনিক বরাবরই ভালো ছেলে ছিল। নিজের ক্ষতি যেনেও মানুষের উপকার করত। কোনো যাত্রীর সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করত না।
কাঁদতে কাঁদতে অনিকের বাবা বাবুল মিয়া কালবেলাকে জানান, তার ছেলে জীবন দিয়ে একটি শিশুকে বাঁচিয়েছে। এটা তো বড় পাওয়া, এই ছেলের জন্য তার গর্ব হয়। কিন্তু কেউ যদি ওই সড়কে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন না নিত, তাহলে এত প্রাণ যেত না। এজন্য তিনি বিচার চেয়ে মিরপুর থানায় মামলা করেছেন।
শিশু হোসাইনের দাদা নাসির হাওলাদার বলেন, বৃহস্পতিবার সকালেই মিজান পরিবারসহ বরিশাল থেকে লঞ্চে করে ঢাকায় আসে। এরপর শ্বশুরবাড়িতে যায়। সেখানে থেকে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরছিল। পথেই ঘটে ওই দুর্ঘটনা। তিনি বলেন, তার নাতি (হোসাইন) বিদ্যুতায়িত না হলেও হাত ও পিঠে আঘাত লেগেছিল।
মিজানের শ্বশুর মো. মহফিজ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মেয়ে ও জামাই, নাতি-নাতি রাতে বাসা থেকে খেয়ে বের হয়। এই বের হওয়া যে শেষ বের হওয়া, তা বুঝতে পারেননি তারা। তাহলে তাদের তিনি ছাড়তেন না। মিজান ঝালমুড়ি ও ভ্যানে করে ফল বিক্রি করত।
হোসাইনকে হাসপাতালে নিয়ে যান দুই হিজড়া: হোসাইনকে বাসায় নিয়ে প্রাথমিক সেবা করেন আমেনা ও বৃষ্টি হিজড়া নামে দুজন। আমেনা জানান, তারা বৃষ্টির সময় বাসাতেই ছিলেন। হৈচৈ শুনে বাসা থেকে বের হয়ে শোনেন, রাস্তায় কারেন্টের তারে কয়েকজন মারা গেছেন। তখন দেখতে পান, ছোট একটা বাচ্চা পানিতে ভাসছে। বাচ্চাটিকে একজন তুলে তার কাছে দেয়।
বৃষ্টি নামে অন্য একজন জানান, শিশুটির নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। তার পরিচিত কাউকে না পাওয়ায় হাসপাতালেও নেওয়া যাচ্ছিল না। তখনো তারা বিস্তারিত পরিচয়ও জানতেন না, শিশুটির নামও জানতেন না। এরপর আমেনা ও তিনি মিলে শিশুটিকে (হোসাইন) হাসপাতালে নিয়ে যান।
তিনি বলেন, পানি মাড়িয়ে আশপাশের কয়েক হাসপাতালে ঘুরলেও কোথাও শিশুটিকে কেউ ভর্তি রাখেনি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো হয়। সেখান চিকিৎসা শেষে শুক্রবার সকালে শিশুটিকে ছেড়ে দেন চিকিৎসকরা। ততক্ষণে ওই শিশুর স্বজনরাও আসেন হাসপাতালে।
আমেনা জানান, হোসাইনকে শুক্রবার সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নিয়ে যান তারা। এরপর মিরপুর থানার ওসির মাধ্যমে স্বজনদের কাছে তুলে দেন।
মন্তব্য করুন