মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বাণিজ্য বা ব্যবসায় শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক ছিল টানা দুই দশক। তবে ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এসএসসি ও এইচএসসিতে কমছে ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীর সংখ্যা। গত ছয় বছরের এসএসসি ও পাঁচ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার গ্রুপভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
শিক্ষাবিদদের মতে, আগের মতো সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে এখন ব্যবসায় শিক্ষা শিক্ষার্থীদের একচেটিয়া প্রাধান্য নেই। তাই এ শাখায় তাদের আগ্রহ দিন দিন কমছে।
শিক্ষা বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালে প্রতিবছরই এসএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগের পরীক্ষার্থী ছিল ৩ লাখের ওপরে। আর ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা নেমে আসে ৩ লাখের নিচে। অন্যদিকে, এইচএসসিতে ২০১৮ থেকে ২০২১ প্রতিবছরই কমার্স বিভাগের পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখের বেশি। তবে ২০২২ সালে সে সংখ্যা ২ লাখের নিচে নেমে যায়।
এবার এসএসসি পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে রেজিস্ট্রেশন করে ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ২৭৫ শিক্ষার্থী। তার মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮১৬ জন। অন্যদিকে, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষার্থী ছিল ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৪ জন। আর মানবিক ছিল ৮ লাখ ২৩ হাজার ৮৮৫ জন। অর্থাৎ মোট সংখ্যার ২০ শতাংশেরও কম ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষার্থী।
এর আগে ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫৭ জন। এর মধ্যে বাণিজ্যে ৩ লাখ ১৪৭ জন। বিজ্ঞানের ৫ লাখ ৭ হাজার ২৫৪ এবং মানবিক থেকে পরীক্ষার্থী ছিল ৭ লাখ ৮১ হাজার ২৫৬ জন।
করোনা-পরবর্তী ২০২১ সালের প্রায় ২০ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪৬ জন ছিল ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের।
২০২০ সালে মোট ১৬ লাখ ৩১ হাজার ৩০৮ এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষার ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৬ জন, বিজ্ঞানে ৫ লাখ ৪ হাজার ৪৩২ জন এবং মানবিকে ছিল ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭০ জন।
২০১৯ সালে বিজ্ঞানে ৫ লাখ ৪১ হাজার ৩২৩, মানবিকে ৭ লাখ ৭১ হাজার ১৯ জন হলেও ব্যবসায় শিক্ষায় পরীক্ষার্থী ছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার ৩১০ জন। আবার, ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৪২৩ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষায় ছিল ৪ লাখের বেশি।
এইচএসসিতে ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ক্রমেই নিচের দিকে। ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম এখনো শুরু না হওয়ায় বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের পর থেকে ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থী কমতে শুরু করে। ২০১৯ থেকে ২০২২ ধারাবাহিকভাবে এইচএসসি পরীক্ষার্থী কমেছে ৪ হাজার, ১৫ হাজার, ২৭ হাজার ও ৩৮ হাজার।
২০১৮ সালে মোট এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন ১০ লাখ ৭২ হাজার ২৮ জন। তার মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষায় পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯৪ জন। বিজ্ঞানে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯০৩ আর মানবিকের ৫ লাখ ৬৪ হাজার ২৩১ জন পরীক্ষায় অংশ নেন।
২০১৯ সালে এইচএসসিতে মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১১ লাখ ২৬ হাজার ১২৬ জন। এর মধ্যে বিজ্ঞানে ২ লাখ ৬২ হাজার ৯৫২ জন, মানবিকে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৯৪ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৮৮০ জন পরীক্ষার্থী ছিলেন। পরের বছর সাড়ে ১১ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষায় ছিলেন ২ লাখ ৪৯ হাজার ৪৪৩ জন।
২০২১ সালে ১১ লাখ ১৫ হাজার ৭০৫ পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬৮ ও মানবিকে ছিল ৬ লাখ ৪২ হাজার ৩১৪ জন। আর ব্যবসায় শিক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ২২ হাজার ৩২৩ জন।
গত বছর এইচএসসি পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেন ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৮ জন। এর মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষায় পরীক্ষার্থী ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৬৯ জন। যেখানে বিজ্ঞান বিভাগে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৮৬৫ আর মানবিকে ছিলেন ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮০৪ জন।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের সঙ্গে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ চালুর পর মানবিকের চেয়ে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষার্থীর হার বাড়তে থাকে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিস্থিতি তেমনই ছিল। তবে এরপর থেকে বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানবিকের শিক্ষার্থী বছর বছর বাড়লেও কমতে থাকে ব্যবসায় শিক্ষায়।
রাজধানীর নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, কয়েক বছর আগেও শুনতাম বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। আর এখন কমছে ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থী। জব অপরচুনিটি (চাকরির সুবিধা) কমে যাওয়া এর একটা কারণ হতে পারে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার কালবেলাকে বলেন, অন্য দেশে বাজার চাহিদার ওপর শিক্ষা নির্ভর করে। তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা তাদের বিষয় পছন্দ করে। আমাদের দেশের একসময় চাকরির বাজার কমার্সমুখী ছিল। পরে কমার্সের শিক্ষার্থী এত বেড়ে যায় যে, অনেককেই বেকার থাকতে হচ্ছে। সে কারণে হয়তো মানবিক এবং বিজ্ঞানের প্রতি বেশি ঝুঁকছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তারিক আহসান বলেন, নতুন প্যাটার্নে কোর্স ডিজাইন করায় একটা সময় ব্যবসায় শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী করপোরেট সেক্টর, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বা প্রাইভেট সেক্টরে নিয়োগে বড় পরিবর্তন আসে। এখন আন্তঃবিভাগীয় পদ্ধতিতে কত বেশি সমস্যার সমাধান করা যায়, সেটিই মূল স্কিল। যেখানে যোগাযোগে দক্ষতা, সহযোগিতার মানসিকতা, দ্রুত সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি গুরুত্ব রাখে। ফলে ব্যবসায় শিক্ষার আলাদা চাহিদা থাকছে না। এজন্য টারশিয়ারি লেভেলের কারিকুলামে সফট স্কিলের দিকে অনেক বেশি ফোকাস করা উচিত। যাতে পরিবর্তনশীল যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো বিভাগের শিক্ষার্থীরা টিকে থাকতে পারে।
মন্তব্য করুন