পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীবাহী লঞ্চে চলছে খরা। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালীসহ বড় রুটে হাতেগোনা কিছু লঞ্চ চলাচল করলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত যাত্রী। তবে ব্যতিক্রম চিত্র ঘটছে ঢাকা থেকে ভোলা রুটে নতুন চালু হওয়া পণ্যবাহী ট্রাক বহনের সুবিধাসহ চলাচল করা জাহাজ কার্নিভাল ক্রুজের ক্ষেত্রে।
এ রুটেও যাত্রী তুলনামূলক কম পেলেও কার্নিভাল ক্রুজে পণ্যবাহী ট্রাকের চাপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ভোলা থেকে প্রতিদিন নানা ধরনের পণ্য নিয়ে জাহাজ ভর্তি ট্রাক আসছে ঢাকায়। কার্নিভাল ক্রুজে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেক ট্রাককেও ফিরে যেতে হচ্ছে। একই দৃশ্য ঢাকা থেকে ভোলা যাওয়ার ক্ষেত্রেও।
ট্রাকচালকরা বলছেন, তিনটি সুবিধার কারণে তারা সড়কপথ পরিহার করে গাড়ি নিয়ে জাহাজে ভোলা যাওয়া-আসা করছেন। এর মধ্যে রয়েছে জাহাজে পণ্য নিয়ে যাওয়া-আসা করায় তাদের সড়কের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না। বিশেষ করে ভোলা থেকে বরিশাল যাওয়া-আসার পথে লাহারহাট ফেরি কিংবা নোয়াখালী হয়ে ভোলা যেতে যে মজু চৌধুরীর হাট ফেরি রয়েছে, সেখানে ফেরি পার হতে ও দুই পাশের দীর্ঘ লাইনে একেকটি গাড়ি পার হতে চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এ ছাড়া লাহারহাট ফেরি রাতে বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। একইভাবে মজু চৌধুরীর হাট ফেরি চলাচল নির্ভর করে অনেকটা জোয়ার-ভাটার ওপর। তাই ট্রাকচালকরা বলছেন, কার্নিভাল ক্রুজ চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে ভোলা যেতে তাদের এখন সময় কম লাগছে। আগে যেখানে সড়কপথে ভোলা যেতে সময় লাগত ১০-১১ ঘণ্টা, সেখানে এখন লাগে পাঁচ ঘণ্টা। এ ছাড়া নদীপথের এই জাহাজে ট্রাক নিয়ে যেতে তাদের খরচও কম লাগছে।
ঢাকা-ভোলা রুটে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ট্রাক চালান কৃষ্ণ দাস। তিনি বলেন, এই লঞ্চ আমার জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে। বিশেষ করে ফেরিতে ট্রাক উঠিয়ে এখন আমরা লঞ্চে ঘুমিয়ে ঢাকা যাওয়া-আসা করতে পারি। কাজও হয়, রেস্টও হয়। কার্নিভাল ক্রুজ জাহাজের নিচতলা করা হয়েছে ফেরির আদলে। আর দুই ও তিনতলায় রয়েছে যাত্রী যাওয়ার জন্য কেবিন, চেয়ার কোচ ও ডেক ব্যবস্থা।
ঢাকা থেকে দ্বীপজেলা ভোলা রুটে গত ১৫ সেপ্টেম্বর চালু হয়েছে এই বিশেষ যাত্রী ও পণ্য বহন করার সুবিধা সংবলিত জাহাজ চলাচল, যা প্রতিদিন ঢাকা থেকে সকাল ৮টায় ভোলার উদ্দেশে ছেড়ে যায় আর ভোলা থেকে প্রতিদিন ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে রাত ৯টায়। আপাতত এই রুটে প্রতিদিন একটি করে জাহাজ চলাচল করে।
পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের দাবি, সময় ও অর্থ বেঁচে যাওয়ায় তাদের আয়ও আগের চেয়ে বেড়েছে। এ ছাড়া সড়কপথে যাওয়া-আসা করলে সময় বেশি লাগায় অনেক সময় কৃষিপণ্য পথেই পচে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। তাই এই রুটে প্রতিদিন কমপক্ষে দুটি করে জাহাজ চলাচলের দাবি পণ্যবাহী যানচালকদের। ট্রাকের পাশাপাশি সুবিধা ভোগ করছেন যাত্রীবাহী গাড়ির মালিকরাও। তারা বলছেন, এখন ইচ্ছা হলেই দ্বীপ জেলায় নিজ বাড়িতে নিজের গাড়িটিও নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। সড়কপথের চেয়ে যাতায়াত খরচও জাহাজে কম হচ্ছে বলে জানান যাত্রীরা।
ফেরি ও লঞ্চ উভয় সুবিধাসম্পন্ন কার্নিভাল ক্রুজটি চলছে বেসরকারি মালিকানায়। তবে জাহাজ চলাচলের জন্য ঢাকা ও ভোলা প্রান্তে ফেরিঘাট সংক্রান্ত সব সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে। উদ্বোধনের সময় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেছিলেন, ঢাকা-ভোলা রুটে প্রয়োজন হলে এ ধরনের আরও পণ্যবাহী ট্রাক বহনকারী জাহাজ চালু করা হবে।
কার্নিভাল ক্রুজ জাহাজের মালিক এম কে শিপিং লাইনসের পরিচালক মাসুম খান জানান, চাহিদার কথা মাথায় রেখে ১৫-২০ দিনের মধ্যে ঢাকা-ভোলা রুটে আরেকটি পণ্যবাহী ট্রাক বহনের সুবিধা সংবলিত জাহাজ চলাচল শুরু করবে। জাহাজের মাধ্যমে যেহেতু পচনশীল কাঁচামাল ও মাছ সহজেই কম সময়ে ভোলা থেকে ঢাকা এনে বেচাকেনা করা যাচ্ছে, তাই এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
কোম্পানি ধীরে ধীরে লাভের মুখ দেখছে জানিয়ে তিনি বলেন, জাহাজে প্রত্যাশা অনুযায়ী পণ্যবাহী ট্রাক উঠলেও যাত্রীর পরিমাণ কম। এ জন্য ভবিষ্যতে শুধু পণ্যবাহী গাড়ির জন্য জাহাজ বানানোর পরিকল্পনা করছি। এমনকি সরকারি সহায়তা পেলে অন্যান্য দ্বীপ জেলা ও উপকূলীয় অঞ্চলেও এ সুবিধার জাহাজ চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান মাসুম খান।
নতুন রুট চালু হওয়া নিয়ে কালবেলা থেকে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে হাতিয়া রুটেও এ ধরনের জাহাজ চলাচল শুরু করা যায় কিনা সে ব্যাপারে যাচাইবাছাইয়ের জন্য বিআইডব্লিউটিএকে বলা হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী বছরের শুরুতেই ঢাকা থেকে হাতিয়া রুটেও এ ধরনের জাহাজ চালু করতে পারবো। তিনি জানান, ইতিমধ্যেই ঢাকা থেকে ভোলা রুটে ফেরি সুবিধার যাত্রীবাহী জাহাজ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ ধরনের নতুন নতুন রুট দ্বীপ জেলাগুলোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।