বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরিন রুপা। ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের অডিটর পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে ডিজিটাল ডিভাইস, মোবাইল ফোন, প্রশ্নফাঁসের ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা এবং প্রশ্নপত্রের কিছু উত্তরের স্ক্রিনশট কপি জব্দ করা হয়। দুই দফায় রিমান্ডেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরবর্তী সময়ে আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন রুপা। মামলার তদন্তে এজাহারনামীয় সাত আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তবে আসামি রুপার বিরুদ্ধে অভিযোগের সম্পৃক্ততা না থাকা এবং পর্যাপ্ত ও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সুস্পষ্ট কোনো উপাদান পায়নি গোয়েন্দা পুলিশ। সে কারণে মামলার দায় থেকে তার অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। যদিও একই অভিযোগে অন্য সাত আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের অডিটর পদে নিয়োগ পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্নপত্রফাঁসের উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ একটি চক্র প্রতারণা করছে, এমন খবর পায় ডিবি পুলিশ। এরপর অভিযান চালিয়ে আল আমিন, রাকিবুল, হাসিবুল ও নাহিদকে প্রশ্নফাঁসে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে তিনটি ডিজিটাল ডিভাইস, তিনটি স্ট্যাম্প, পাঁচটি ব্যাংক চেক, মাইক্রোফোন ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। তাদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা থেকে মাহবুবা নাসরিন রুপাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার শপিং ব্যাগ তল্লাশি করে একটি ডিভাইস, মোবাইল ফোন, অডিটর পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড ও প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। রুপার মোবাইল ফোন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হিরন ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তি মেসেঞ্জারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের কিছু উত্তর তার মোবাইল ফোনে পাঠিয়েছেন, যা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলে যায়। সেগুলোর স্ক্রিনশট কপি জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার রাজু আহম্মেদের কাছ থেকে অডিটর পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় ২৪ জানুয়ারি ডিবি গুলশান বিভাগের উপপরিদর্শক শহিদুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা মডেল থানায় মামলা করেন। ১৬ মাস তদন্ত শেষে গত ৪ জুন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডিবি পুলিশের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক মাকারিয়াস দাস আদালতে চার্জশিট জমা দেন।
আদালতে স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন রুপা : রিমান্ড শেষে ২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আসামি রুপা ও হাসিবুলকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর ডিবি গুলশান বিভাগের উপপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী তাদের জবানবিন্দ রেকর্ড করার আবেদন করেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের অডিটর পদে নিয়োগ পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র ফাঁস করে ডিজিটাল প্রতারণার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন এবং ঘটনায় জড়িত বলে জানান। তারা ঘটনায় জড়িত মর্মে স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে ইচ্ছুক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিবের আদালত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
চার্জশিটে আসামি রুপার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে : আসামি রুপা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে তিনি নিজে প্রত্যক্ষভাবে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন, এমন বক্তব্য নেই। পরীক্ষার হলে প্রবেশের আগেই তাকে গ্রেপ্তার করায় হাতে থাকা ডিভাইসটি ব্যবহার করতে না পারায় সেটি দ্বারা বেনিফিশিয়ারি নন রুপা। তার কাছে থেকে জব্দকৃত আলামত আইটি ফরেনসিক শাখা থেকে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা শেষে মতামত দেওয়া হয়, আইফোনে অডিট পদে নিয়োগ পরীক্ষা-সংক্রান্ত কোনো অডিও, ভিডিও এবং এসএমএস আদান-প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ আইডিটি আউট অব ডেট (ভার্সন এক্সপায়ার্ড) এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারের লগইন ক্রেডেনশিয়াল না থাকায় মেসেজ কনটেন্ট পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সিআইডির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের মতামত পর্যালোচনায় জানা যায়, আসামি রুপার ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও আইফোনে অডিট পদে নিয়োগ পরীক্ষা-সংক্রান্ত কোনো অডিও, ভিডিও এবং এসএমএস আদান-প্রদানের নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি বিধায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো ধারায় অপরাধ প্রমাণ করার আইনত সুযোগ নেই। আসামি মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার হকদার এবং এ মামলায় অপরাধ প্রমাণের মতো উপাদান অনুপস্থিত। দীর্ঘদিন তদন্তের সময় সাক্ষ্য প্রমাণে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায়, আলামত এবং আলামতের পরীক্ষার প্রতিবেদন পর্যালোচনায় মামলার ঘটনাটি এজাহারনামীয় আসামি রুপার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সম্পৃক্ততা না থাকায় এবং পর্যাপ্ত ও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সুস্পষ্ট উপাদান না থাকায় তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দানের প্রার্থনা জানানো হয়েছে।
অভিযুক্ত সাত আসামির বিরুদ্ধে যা বলা হয়েছে : আসামি মো. আল আমিন আজাদ রনি, মো. রাকিবুল হাসান ও নাহিদ হাসান মামলার ঘটনার অপরাধবিষয়ক ছক তৈরি করে। তারাই মূল মাস্টারমাইন্ড। পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ডিফেন্স ফাইন্যান্স নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র পাঠানোর ডিভাইস সরবরাহ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৩/২৪ ধারায় অপরাধ করেছে। অন্যদিকে, আসামি মো. হাসিবুল হাসান, মাহবুবা নাসরিন রুপা ও মো. রাজু আহম্মেদ অডিট নিয়োগ পরীক্ষার্থী। হাসিবুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আইটি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তার জব্দকৃত মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে মতামত দেন, নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তরের সদৃশ এসএমএস রিসিভ করার তথ্য পাওয়া গেছে। মোবাইল ফোনে অডিট পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড পাওয়া যাওয়ায় তার বিরুদ্ধে একই আইনের অপরাধ উপাদান সুস্পষ্ট ও দালিলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিধায় সে সুস্পষ্টভাবে অভিযুক্ত। আসামি রাজুর কাছ থেকে জব্দ করা দুটি মোবাইল ফোন ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়। তার মোবাইল ফোনে অডিট নিয়োগের বিভিন্ন আইডির অ্যাডমিট কার্ডের এসএমএস এবং বিভিন্ন ব্যক্তির অ্যাডমিট কার্ডের ছবি পাওয়া গেছে। প্রশ্নপত্রের ওপরের অংশবিশেষ প্রেরণ করার তথ্যও পাওয়া গেছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আল আমিন কালবেলাকে বলেন, মামলায় পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। এটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেখানে মামলার বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন